Advertisement
E-Paper

কৃত্রিম পা নিয়েই লড়াইয়ে জিতছেন এই সার্জেন্ট

সহকর্মীদের স্মৃতিতে এখনও টাটকা ৭ জুনের ঘটনা। ডাফরিন রোডে ডিউটি করার সময়ে বেপরোয়া এক মিনিবাস ধাক্কা মেরেছিল সুদীপবাবুকে। পিষে দিয়েছিল তাঁর ডান পা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৪০
অপরাজিত: স্ত্রী প্রণতির সঙ্গে সুদীপ রায়। (ডান দিকে) কৃত্রিম এই পায়ে ভর দিয়েই নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

অপরাজিত: স্ত্রী প্রণতির সঙ্গে সুদীপ রায়। (ডান দিকে) কৃত্রিম এই পায়ে ভর দিয়েই নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

চোর-ডাকাত ধরা বা রাস্তায় যানশাসনের থেকে এ অনেক কঠিন লড়াই! তবু সেই লড়াইয়ে জিতছেন কলকাতার এক তরুণ পুলিশ অফিসার। কৃত্রিম পা দিয়েই হাঁটছেন, সিঁড়ি ভাঙছেন, মোটরবাইক চালাচ্ছেন। দিন গুনছেন, কবে ফের উর্দি পরে দাঁড়াবেন মহানগরীর রাস্তায়।

তিনি সুদীপ রায়। ২০১৪ ব্যাচের এই সার্জেন্টকে কার্যত বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল বেপরোয়া এক মিনিবাস।

সহকর্মীদের স্মৃতিতে এখনও টাটকা ৭ জুনের ঘটনা। ডাফরিন রোডে ডিউটি করার সময়ে বেপরোয়া এক মিনিবাস ধাক্কা মেরেছিল সুদীপবাবুকে। পিষে দিয়েছিল তাঁর ডান পা। টুকরো হয়ে যাওয়া কোমরসন্ধি বা পেলভিস জয়েন্ট, থেঁতলে যাওয়া পা নিয়ে সুদীপবাবু ভর্তি হন একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা প্রাণ বাঁচালেও বাদ দিতে হয় তাঁর ডান পা।

সুদীপবাবুর কর্মস্থল সাউথ ট্র্যাফিক গার্ডের এক সার্জেন্ট বলছেন, ‘‘সে বড় কঠিন সময়। বছর পঁয়ত্রিশের তরতাজা ছেলেটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভীষণ আতঙ্কিত। ও কিন্তু মনের জোর হারায়নি।’’ মনের জোর না হারানোর কথা বলে চলেছেন সুদীপবাবুর পরিজনেরাও। তাঁরা জানান, হাসপাতালে যাওয়ার পথে সুদীপ বলেছিলেন, ‘‘আমার কিছু হয়নি।’’ প্রয়োজনে পা বাদ দেওয়ার কথা নিজেই চিকিৎসকদের বলেছিলেন ওই সার্জেন্ট। পা বাদ যাওয়ার পরে ভেঙে পড়েননি। এখন তাঁকে কখনও সামান্য দুর্বল হতে দেখলেই স্ত্রী প্রণতি বলে ওঠেন, ‘‘আমি চাই না, তুমি কোনও দিন হেরে যাও।’’

আরও পড়ুন: নিম্নচাপের পথ বদল, বৃষ্টিভেজা দক্ষিণবঙ্গ

‘‘হারব না, এই জেদটা চেপে বসেছিল। তবে পরিবার, সহকর্মী ও বাহিনীর কর্তারা পাশে না থাকলে মনের জোরটা ধরে রাখতে পারতাম না,’’ শনিবার বেহালার সরকারি আবাসনে বসে বলছিলেন সাউথ ট্র্যাফিক গার্ডের ওই সার্জেন্ট। সেই প্রসঙ্গেই বললেন দাদা মলয় রায়ের (বর্তমানে পূর্ব যাদবপুর ট্র্যাফিক গার্ডের অতিরিক্ত ওসি) কথা। পিতৃসম দাদা ভাইয়ের পা বাদ যাওয়ার পরে সামনে যেতে পারেননি। কিন্তু জ্ঞান ফিরতেই ভাই ডেকে নিয়েছিলেন তাঁকে। সেই থেকে ভাইয়ের পাশে বসে সারা ক্ষণ সাহস জুগিয়েছেন তিনি। বাকিটা করেছেন এক ‘নতুন’ দাদা! তিনি কে?

কাজে ফেরার আগে চলছে মোটরবাইকে চড়ার মহড়া।

সুদীপবাবু জানান, হাসপাতালে এক দিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। তখনই মলয়বাবুকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘উনি তোমার নিজের দাদা ঠিকই। কিন্তু আমিও তোমার দাদার মতো। ভয় পেও না, আমরা তোমার পাশে আছি।’’ সিপি-র নির্দেশ মতোই বেনিয়াপুকুরের একটি সংস্থার মাধ্যমে জার্মানি থেকে উন্নত মানের কৃত্রিম পা আনানো হয়। ১৬ অক্টোবর অস্ত্রোপচার করে কৃত্রিম পা বসানো হয় সুদীপবাবুর শরীরে। পরিজনেরা বলছেন, টাকা জুগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি লালবাজার। এখনও নিয়মিত ফোন করে খোঁজ নেন পুলিশকর্তারা।

সুদীপবাবুর অস্ত্রোপচারকারী দুই চিকিৎসক, অর্থোপেডিক সার্জন চন্দ্রশেখর ধর ও প্লাস্টিক সার্জন অনুপম গোলাস রোগীর মনের জোরকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন। চন্দ্রশেখরবাবু বলছেন, ‘‘মনের জোরে কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ে অনেকেই অসাধ্যসাধন করেছেন। সুদীপবাবুও মনের জোরেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।’’ একই কথা বলছেন ডিসি (ট্র্যাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমারও। তাঁর মতে, ‘‘অবিশ্বাস্য ঘটনা! এত মনোবলও কারও থাকতে পারে! আশা করি, খুব শীঘ্রই উনি কাজে ফিরবেন।’’

অনেকেরই এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে অ্যাথলিট অস্কার পিস্টোরিয়াসের কথা। জন্মগত রোগ ও ১১ মাসে দুই পা হারানো দক্ষিণ আফ্রিকার ওই অ্যাথলিট কৃত্রিম পা নিয়েই হয়ে উঠেছেন ‘ব্লেড রানার’। বা এ দেশেরই সুধা চন্দ্রন। ১৬ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি। কিন্তু কৃত্রিম পা নিয়েই হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। একই ভাবে কৃত্রিম দুই পা নিয়েই মডেলিং থেকে প্যারাঅলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জেতার মতো কাজ করে গিয়েছেন আমেরিকার অ্যামি পার্ডি।

এ সব মাথায় রেখেই সুদীপবাবু জানান, কৃত্রিম পা বসানোর পর থেকেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা শুরু হয়েছে তাঁর। টলোমলো ভাবে হাঁটাচলা, সিঁড়ি ভাঙা চলছিল। এর মধ্যেই ইউটিউব ঘাঁটতে গিয়ে সুদীপবাবু দেখেন, দুর্ঘটনায় পা হারানো এক জন কৃত্রিম পা নিয়ে মোটরবাইক চালাচ্ছেন। তা দেখেই সাহসে ভর দিয়ে শুরু দু’চাকায় চাপা। ‘সার্জেন্ট’ ভাইয়ের এমন কীর্তি দেখে ‘ওসি’ দাদা বলছেন, ‘‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!’’

বছর দশেকের ছেলে সৌমিক আগে বাবাকে পেলেই খুনসুটি জুড়ত। হাসপাতাল থেকে ফেরা ইস্তক তেমনটা করছে না। সৌমিক স্বপ্ন দেখে, ফের বাবার সঙ্গে খুনসুটি করার। প্রণতি স্বপ্ন দেখেন, আগের মতোই নিয়মভাঙা গাড়িকে থামাবেন স্বামী। সুদীপবাবু জানেন এবং বিশ্বাস করেন, সব স্বপ্নই সত্যি হবে।

শুধু সময়ের অপেক্ষা।

—নিজস্ব চিত্র

Sudip Roy সুদীপ রায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy