Advertisement
E-Paper

রেডিও-সাগরে ঢেউ তুলেছে মহালয়া

মহালয়ার আগে বিকল হয়ে যাওয়া ভালভ-রেডিও সারাতে কসবা থেকে কাঁকুড়গাছি ছুটেছিলেন প্রৌঢ়। যতই টিভি থাক, রেডিওতে না শুনলে মহালয়ার চণ্ডীপাঠ কেমন পানসে লাগে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২০
নিজের বাড়িতে ভাল্ভ-রেডিও সারাতে ব্যস্ত সাগর সান্যাল। কাঁকুড়গাছিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নিজের বাড়িতে ভাল্ভ-রেডিও সারাতে ব্যস্ত সাগর সান্যাল। কাঁকুড়গাছিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

মহালয়ার আগে বিকল হয়ে যাওয়া ভালভ-রেডিও সারাতে কসবা থেকে কাঁকুড়গাছি ছুটেছিলেন প্রৌঢ়।

যতই টিভি থাক, রেডিওতে না শুনলে মহালয়ার চণ্ডীপাঠ কেমন পানসে লাগে। নম্বর জোগাড় করে ফোন করলেন কাঁকুড়গাছির সুরেন্দ্রনাথ কো-অপারেটিভ আবাসনে।

হঠাৎ রেডিও নিয়ে সবাই ওখানেই ছুটছেন কেন? কারণ, সেখানেই থাকেন এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। পেশায় শারীরবিদ্যার শিক্ষক হলেও নেশায় ‘রেডিও মেকার’। রবিবার মহালয়ার আগের দিন সাগর সান্যাল নামে ওই বৃদ্ধের ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল সারি সারি রেডিও সেট। রয়েছে সাবেক টেপ রেকর্ডারও। এ বারই যেমন এক ব্যক্তি টেপ রেকর্ডার সারিয়ে দেওয়ার আব্দার জুড়েছেন। দিনভর খেটে তা সারিয়েও দিয়েছেন সাগরবাবু। আজ, সোমবার ভোরে রেডিওর মহালয়া ‘স্পুল রেকর্ডারে’ ধরে রাখবেন তার মালিক।

সময় যতই বদলাক, যতই টিভিতে জাঁকিয়ে বসুক মহিষাসুরমর্দিনী, রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ না শুনলে আজও যেন ঠিক উৎসবের আমেজ আসে না! তা তিনি কর্পোরেট কর্তাই হন বা ছাপোষা কেরানি। সেই রেডিও প্রীতির জেরেই দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না সাগরবাবু। নিত্যদিনই কেউ না কেউ হাজির হচ্ছেন বাড়িতে। কোলে সাবেকি রেডিও সেট। সে সব দেখাতে দেখাতে বছর সত্তরের বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘‘এটার বয়স ষাট। ওটার সত্তর!’’

ভাল্ভ রেডিও আদতে বৈদ্যুতিক রেডিও। কাঠের বাক্সে ভরা এই রেডিওয় ভরপুর পুরনো দিনের স্মৃতি। আওয়াজও অনেক গমগমে। তাই চণ্ডীপাঠের একটা আলাদা মজাও থাকে। এ শহরের এক প্রবীণের স্মৃতিচারণ, ‘‘বাড়িতে বিরাট মাপের একটা ভালভ রেডিও ছিল। মহালয়ার ভোর হওয়ার আগেই পাড়ার বুড়ো-বাচ্চা এসে বৈঠকখানায় জুটত। চণ্ডীপাঠ শুরু হতেই পিনড্রপ সাইলেন্স!’’

রেডিওর মহালয়া নিয়ে স্মৃতি রয়েছে এ প্রজন্মের অনেকেরই। বছর ত্রিশের যুবক বলছেন, ‘‘স্কুলজীবনে মহালয়ার আগের রাতেই মামাবাড়ি যেতাম। ভোরে উঠেই কে রেডিওর কাছে পজিশন নিতে পারে, চলত প্রতিযোগিতাও।’’ তাঁর ছোটবেলা থেকেই অবশ্য টিভিতে চালু হয়ে গিয়েছিল মহালয়ার শো। কোনও বার তাতে দেবী সাজতেন বলিউডি হিরোইন, কোনও বার টলিউড সুন্দরী। তাই রেডিও শেষ হতেই টিভিতে চোখ। ‘‘তবে রেডিওর মজাটাই আসল। চণ্ডীপাঠ শুনতে শুনতে আঁধার কেটে আলো বেরোনো দেখার আলাদা মজা ছিল,’’ বলছেন ওই যুবক।

সিডির দৌলতে সারা বছরই এখন মহিষাসুরমর্দিনী বাজে। অনেকেই বলেন, রেডিওর মহালয়ার সেই আমেজ কেটে গিয়েছে। যেমন এক মাঝবয়সী মহিলার বক্তব্য, ‘‘মে মাসের ভরদুপুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। কানে এল, আশ্বিনের শারদপ্রাতে। কেমন মাথা গরম হয়!’’ কিছু দিন আগেই অফিসে ঢুকে চিৎকার জোড়েন গাঁধী কলোনির বাসিন্দা প্রবীণ, ‘‘ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় মহিষাসুরমর্দিনী শোনানোর কী আছে!’’ শরতের ভোরে রেডিওয় চণ্ডীপাঠ কী, তা ঠিক মতো জানে না সদ্য কৈশোরের অনেক ছেলে-মেয়েই। যেমন ক্লাস সেভেনের এক ছাত্র। ভোরে মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনবে কি না, এই প্রশ্ন করতেই জবাব, ‘‘শুনতে ইচ্ছে করলে পরে ইউটিউবে শুনে নেব।’’

কিন্তু সাবেক রেডিও নিয়ে এখনও মজে অনেকেই। যেমন কাঁকুড়গাছির সাগরবাবুই। রেডিও তাঁর এমনই নেশা যে, পুরনো রেডিও সারিয়ে কোনও পয়সা নেন না। কারণ, এ তাঁর ভালবাসা। বসার ঘরে সাজানো রেডিওয় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘‘১৯৫৮ সালে কাকা অচিন্ত্যমোহন সেনগুপ্তের হাত ধরে প্রথম রেডিও বানিয়েছিলাম। ১৯৬২ সালে বাবা প্রথম রেডিও কিনে আনলেন।’’ তার পর থেকে কত যে রেডিও বানিয়েছেন আর সারিয়েছেন! ‘‘ছোটবেলায় রেডিও-প্রেমের জেরে বাবার ঠ্যাঙানি খেয়েছি। এখন বুড়ো বয়সে পরিবারের গঞ্জনাও সহ্য করি,’’ হাসতে হাসতে বলছেন সাগরবাবু।

এক ঝরতি-পড়তি জিনিসপত্রের কারবারির কাছে ভাঙাচোরা ভালভ রেডিও দেখেছিলেন বৃদ্ধ। কিনে এনে নতুন করে সাজিয়েছেন। বললেন, ‘‘এখন দিব্যি গমগমে আওয়ার বেরোচ্ছে। কে বলবে, এটা ভেঙে গিয়েছিল!’’

সাগরবাবুর ইচ্ছে, নতুন করে সাজিয়ে তোলা রেডিওতেই আজ চণ্ডীপাঠ শুনবেন।

kuntak chattopadhyay old radio mahalaya old radio set mahalaya radio mahishasurmardini
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy