Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চা বাগানের উদ্বেগের কথা ভোটের শহরে

সেই দিদি এখন কলকাতায়। সঙ্গে এসেছে তারই মতো আরও বারো জন কিশোরী। তাদের মধ্যে যোগসূত্র একটাই। চা বাগান। কেউ বীরপাড়া, রহিমপুর, আথিয়াবাড়ি, তো কেউ বা ভাঙাবাড়ি চা বাগানের কর্মীদের বাড়ির মেয়ে। গত কয়েক বছরে তারা দেখেছে এ রাজ্যের এক-একটি চা বাগান বন্ধ হয়ে যেতে।

শনিবার আলোচনাসভায় আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের কন্যারা। নিজস্ব চিত্র

শনিবার আলোচনাসভায় আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের কন্যারা। নিজস্ব চিত্র

সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯ ০২:৪৭
Share: Save:

বাড়ির ধারকাছে কাজ নেই। মা কাজ নিয়ে চলে গিয়েছেন সেবকে। বছর পনেরোর দিদি থাকে বাড়িতে। ছোট দুই ভাইকে মা রেখে গিয়েছেন তারই ভরসায়। সেখান থেকেই টাকা পাঠানোর কথা। তা দিয়েই লেখাপড়া করবে সন্তানেরা। তবে টাকা পৌঁছয়নি। আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের যে পড়শির সঙ্গে মা টাকা পাঠিয়েছিলেন, তিনি তা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। সেই কিশোরী দিদিকেই এ দিক-সে দিক কাজ করে জোগাড় করতে হয়েছে ভাইদের স্কুলে ভর্তির টাকা।

সেই দিদি এখন কলকাতায়। সঙ্গে এসেছে তারই মতো আরও বারো জন কিশোরী। তাদের মধ্যে যোগসূত্র একটাই। চা বাগান। কেউ বীরপাড়া, রহিমপুর, আথিয়াবাড়ি, তো কেউ বা ভাঙাবাড়ি চা বাগানের কর্মীদের বাড়ির মেয়ে। গত কয়েক বছরে তারা দেখেছে এ রাজ্যের এক-একটি চা বাগান বন্ধ হয়ে যেতে। পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সি এই কিশোরীদের সকলেরই নিত্যসঙ্গী এখন অনিশ্চয়তা। তবে দিন বদলের আশা ছাড়েনি ওরা। রসিতা চিগবারাইক, বীণা তোপো, উমা দেবী, অঞ্জলি ঠাকুর, মেনকা ওরাঁও, দিব্যা লাকরা, সঞ্জনা ভক্তদের সেই দলটি জানে, তা করতে হবে নিজেদেরই। অনেকেই সপরিবার অন্য কোনও শহর কিংবা গ্রামে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে চায় লেখাপড়া, সেলাই, গাড়ি চালানোর পাঠ। বছর পনেরোর রসিতা আবার আইপিএস অফিসার হতে চায়। তার বিশ্বাস, তাদের মধ্যে থেকে কেউ পুলিশ হলে তবেই বুঝবে চা বাগানের মানুষদের সমস্যা। তবে দিব্যা, সঞ্জনারা জানে, আইপিএস অফিসার হওয়ার জন্য যতটা পড়াশোনা করতে হয়, তা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ওদের নেই। শনিবার ভোটের শহরে এসে এক আলোচনাসভায় নিজেদের অঞ্চলের সে সব কথাই শোনাল ওরা। রোজনামচার অনিশ্চয়তার কাহিনি উঠে এল কথায় কথায়।

ওই কিশোরী দিদি পেরেছিল ভাইদের স্কুলের টাকা জোগাড় করতে। তবে সকলে তা পারেনি। ঘরে ঘরে টাকার অভাবে স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা। যারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরও সামর্থ্য নেই পছন্দমতো স্কুলে যাওয়ার। গাড়ি ভাড়া দেবে কে— শহর কলকাতায় এসে প্রশ্ন তুলেছে উমা, মেনকারা। পায়ে হেঁটে যে স্কুলে পৌঁছনো সম্ভব, সেখানেই যায় ওদের কেউ কেউ। সেখানে পৌঁছেও যে পড়াশোনা হয় সব সময়ে, তেমনটা নয়। শিক্ষকেরও তো অভাব রয়েছে। অঞ্জলি তাই বলে, ‘‘আমি শিক্ষক হতে চাই।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বেশ কিছু দিন হল, চা বাগান চত্বরে সব সময়ে কাজ জোটে না ওদের পরিজনদের। মাঝেমাঝে চা পাতা তোলার বরাত মেলে, তবে লোকের তুলনায় কাজের জোগান অনেক কম। পেট চালানোর তাগিদে চলে অন্য কাজের সন্ধান। বড় বড় মালবাহী গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যায় এলাকার লোকেদের। দূরের নির্মাণস্থলে হয়তো বা কাজ মেলে ক’দিনের। তবে তাতে অভ্যস্ত নন চা বাগানের কর্মীরা। ফলে অসুস্থতাও বাড়ছে। আয় যা হয়, তাতে দু’বেলা গোটা পরিবারের খাবার জোটানোই দায়। ফলে ওষুধ কেনার টাকা মেলে না। বাড়তে থাকে সমস্যা। টানাটানির পরিস্থিতিতে পারিবারিক হিংসার শিকারও হয় বহু মেয়ে।

উত্তরবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে চায় ওদের পরিবার-পড়শিরা। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষেই ছড়িয়ে পড়ছে কলকাতা, গুয়াহাটি, চেন্নাই, মুম্বই— সর্বত্র। কিছু ‘সম্মানজনক’ কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠানোই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু চা বাগান ছেড়ে বেরোনোর পরে খোঁজ মেলে না অনেকের। কাজ দেওয়ার নামে পাচারচক্র রীতিমতো সক্রিয় এই সুযোগে। ওই কিশোরীদের ‘সেফ মাইগ্রেশন’ পদ্ধতির পাঠ দিতেই তাই শহরে নিয়ে এসেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের তরফে বৈতালী গঙ্গোপাধ্যায় জানান, এই কিশোরীরা সকলেই বেশ কিছু দিন ধরে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে চা বাগানের মানুষদের অসুবিধার কথা শুনছে। তা সমাধানের চেষ্টায় কাজও করছে। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েদের কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে পাচারের সমস্যা খুবই গুরুতর আকার নিয়েছে ওই সব এলাকায়। মেয়েরা নিজেরাই যাতে সাবধান থাকতে পারে, তাই এ শহরের আইনজীবী, সমাজকর্মী, সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলিয়ে ওদের সতর্ক রাখার চেষ্টা চলছে।’’

ওই কিশোরীরা অবশ্য জানে, এমন সঙ্কটের সময়ে ভয় পাওয়ার অধিকারটুকুও নেই ওদের। ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকতে চায়ও না। ওদের অঞ্চলের সমস্যার কথা জানেন সকলেই। তবে সব দলের ভোটপ্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির তালিকায় সেখানকার মানুষদের পরিস্থিতি বদলের কথা আছে কি না, তা-ও জানা নেই ভাল ভাবে। সে সব ভয়, ভরসার ঘেরাটোপ যে ওদের জগৎ থেকে এখন বেশ দূরে— তা-ই ওরা শহর কলকাতাকে শোনাল ঠিক পঞ্চবাষির্কী প্রতিশ্রুতি পর্ব শুরুর মুখে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North Bengal Workshop Tea Garden
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE