Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
একবালপুরে অবৈধ নির্মাণ

ঘিঞ্জি গলিতেই বহুতলের সারি

ঘিঞ্জি গলিতে দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। অথচ, তারই ভিতরে ছ’তলা বহুতল। গায়ে গায়ে আরও চারটে বাড়ি! সরু, একচিলতে সিঁড়ি। তা দিয়ে উঠতেই প্রতি তলায় পায়রার খোপের মতো ঘর। দিনের বেলাতেও আলো না জ্বালালে দেখা যায় না। প্রতি তলাতেই ইচ্ছেমতো পিলার গেঁথে ঘর তোলা হয়েছে। সাধারণ চোখে দেখেই বোঝা যায়, বাড়ি তৈরির সরকারি নিয়ম এখানে মানা হয়নি। তবে একবালপুর-সহ বন্দর এলাকার যে কোনও মহল্লায় গেলে মনে হবে নিয়ম ভাঙাটাই বোধ হয় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! এবং এই নিয়ম ভাঙার ফলেই জাঁকিয়ে বসেছে সেলামি রাজ। একবালপুরে মা ও দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ডের পিছনেও সেলামিতে নেওয়া ফ্ল্যাট দখলকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা।

শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০২:১২
Share: Save:

ঘিঞ্জি গলিতে দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। অথচ, তারই ভিতরে ছ’তলা বহুতল। গায়ে গায়ে আরও চারটে বাড়ি! সরু, একচিলতে সিঁড়ি। তা দিয়ে উঠতেই প্রতি তলায় পায়রার খোপের মতো ঘর। দিনের বেলাতেও আলো না জ্বালালে দেখা যায় না। প্রতি তলাতেই ইচ্ছেমতো পিলার গেঁথে ঘর তোলা হয়েছে।

সাধারণ চোখে দেখেই বোঝা যায়, বাড়ি তৈরির সরকারি নিয়ম এখানে মানা হয়নি। তবে একবালপুর-সহ বন্দর এলাকার যে কোনও মহল্লায় গেলে মনে হবে নিয়ম ভাঙাটাই বোধ হয় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! এবং এই নিয়ম ভাঙার ফলেই জাঁকিয়ে বসেছে সেলামি রাজ। একবালপুরে মা ও দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ডের পিছনেও সেলামিতে নেওয়া ফ্ল্যাট দখলকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা।

সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা এলাকায় বেআইনি নির্মাণ নিয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে একটি চিঠিও দিয়েছেন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বুধবার এ বিষয়ে মেয়র জানান, নজরদারি চলছে। অবৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

পুরসভা সূত্রের খবর, বহুতল নির্মাণে পুরসভার নির্দিষ্ট বিধি না মানলে তা অবৈধ নির্মাণ বলে ঘোষণা করা হয়। অবৈধ নির্মাণের বহুতলগুলি কেনা-বেচা করাও যায় না। ফলে মৌখিক কথার ভিত্তিতেই সেলামির টাকা বিনিময় হয়। ফ্ল্যাট হস্তান্তরও। আর এই সেলামিতে নেওয়া ফ্ল্যাটের দখল নিয়ে লেগে থাকে গোলমালও। একবালপুর হত্যাকাণ্ডের পর ওই এলাকায় অবৈধ নির্মাণ এবং সেলামি চক্রের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগও উঠেছে। এ বিষয়ে লালবাজার সরাসরি কোনও মন্তব্য না করলেও পুলিশি মদত ছাড়া যে অবৈধ নির্মাণ সম্ভব নয়, তা মেনে নিচ্ছে পুলিশের একাংশই।

কিন্তু পুলিশ কী ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে অবৈধ নির্মাণ চক্রে?

লালবাজারের খবর, অবৈধ নির্মাণ হওয়ার সময়ে আটকাতে হয়। তা ভেঙে ফেলার নিয়মও রয়েছে। এমন নির্মাণের অভিযোগ পেলে থানাই তা পুরসভাকে জানায়। কিন্তু নির্মাণ হয়ে গেলে তা আর ভাঙার উপায় নেই। নির্মাণের সময়ে যাতে কোনও বাধা না আসে কিংবা অভিযোগ এলেও কী ভাবে তা আইনের ফাঁক গলে বেরোনো যায়, সেটাই দেখে পুলিশের একাংশ। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ থাকলেও একবালপুর-সহ বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় তা হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। কিন্তু পুলিশি সক্রিয়তার দেখা মেলে না বলেই স্থানীয়দের অভিযোগ।

গত তিন বছরে কলকাতা পুরসভার ৭৫, ৭৭ ও ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের ডেন্টমিশন লেন, সুধীর বসু রোড, মৌলানা আলি রোড, ইব্রাহিম রোড, ময়ুরভঞ্জ রোড, নবাব আলি লেন এলাকায় অবৈধ নির্মাণের হিড়িক পড়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও ফাঁকা জমি পড়ে নেই। অভিযোগ, পুরনো বাড়ির মালিকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে এলাকার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। টাকা নাও, বাড়ি ছাড়ো। না হলে নানা রকম দাওয়াই রয়েছে। পুরনো বাড়ির মালিকদের এলাকা-ছাড়া করতে মারধর-খুন-জখমেও পিছপা নয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অবৈধ বহুতলগুলির জন্য পুরসভার পানীয় জল চুরির অভিযোগও উঠেছে।

কিন্তু ওই এলাকাগুলিতে অবৈধ নির্মাণের এত বাড়বাড়ন্ত কেন?

মোমিনপুরের এক তৃণমূল নেতা জানান, ওই সব এলাকার বহু বাসিন্দা হংকং, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর থেকে বিদেশি পণ্য এনে খিদিরপুরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। ওই সব ব্যবসার কাঁচা টাকাই অবৈধ নির্মাণের মূল পুঁজি। সেই পুঁজি খাটিয়ে অবৈধ নির্মাণ থেকেও প্রচুর আয় করা হয়। কী রকম?

বন্দর এলাকায় সাধারণত আবাসনের বাজারদর পাঁচ-ছ’হাজার টাকা বর্গফুট। কিন্তু অবৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রে তা আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজারে মেলে। নিয়ম ভেঙে বহুতল তৈরির ফলে নিজের খুশি মতো মাপের ফ্ল্যাটও তৈরি করা যায়। তা সে ১০০ বর্গফুটই হোক কিংবা ১৩০০ বর্গফুট! স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, অবৈধ ফ্ল্যাটগুলি শুধু থাকার জন্য নয়, গুদাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। “কাছের বাজারগুলিতে অনেক দোকানদারই এই সব ফ্ল্যাটে পণ্য ডাঁই করে রাখেন।” বললেন ওই বাসিন্দা।

পুরসভা সূত্রের খবর, ওই এলাকায় ডেন্টমিশন রোড এলাকায় কয়েক মাস আগে দু’টি বহুতল বাজার নির্মাণ হয়েছে। পুরসভায় নকশা অনুমোদন অবশ্য করা হয়েছে। কিন্ত নকশার অনুমোদনের শর্ত মানা হয়নি। ফলে পরোক্ষ ভাবে আইন অনুযায়ী ওই দু’টি বহুতল বাজারই অবৈধ নির্মাণের আওতায়। কিন্তু ওই বহুতল বাজারেই ৬০ হাজার টাকা বর্গফুট দরে মুড়ি-মুড়কির মতো দোকান বিক্রি হয়েছে!

যদিও অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানের দাবি করেছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবৈধ নির্মাণ ভেঙে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ওই এলাকার বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।”

মেয়রকে চিঠি পুরমন্ত্রীর
নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা পুরসভা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি নির্মাণ চলছে, এ কথা মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে জানালেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। গত ১০ এপ্রিল মেয়রকে দেওয়া ওই চিঠিতে মন্ত্রী লিখেছেন, লোকসভা নির্বাচনের কাজের জন্য পুলিশ-প্রশাসন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। আর তার সুযোগ নিয়েই কিছু অসাধু ব্যক্তি তাদের অনুমোদিত নকশার বাইরে বেআইনি নির্মাণ করছে। নজরদারি চালিয়ে এই ধরনের সমস্ত বেআইনি নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব বলেই মন্ত্রী মনে করছেন। এ বিষয়ে বুধবার মেয়রকে প্রশ্ন করা হলে শোভনবাবু বলেন, “আমরা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোনও রকম বেআইনি নির্মাণকাজ হচ্ছে জানতে পারলেই তত্‌ক্ষণাত্‌ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE