জুয়েল সাহা
বন্দর এলাকায় বেআইনি ধরপাকড়ে তাঁর বেশ নামডাক ছিল। স্বভাবতই বেড়েছিল শত্রুর সংখ্যা। তাই কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট জুয়েল সাহার (৩২) মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ পুলিশ।
এই ঘটনায় একটি খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। তদন্তভার দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখাকে।
গত শুক্রবার, ৬ জুন দুপুরে সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোড ও হাইড রোডের মোড়ে ডিউটি করার সময়ে একটি মালবাহী গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর জখম হন দক্ষিণ-পশ্চিম ট্রাফিক গার্ডের সার্জেন্ট জুয়েল। মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান ওই সার্জেন্ট।
এই নিয়ে এ বছর এখনও পর্যন্ত কর্তব্যরত অবস্থায় তিন ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু হল। জখম হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি। কোনও ক্ষেত্রেই খুনের মামলা রুজু করা হয়নি। পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, সেগুলি দুর্ঘটনায় মৃত্যু। ট্রাফিক পুলিশকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার অভিসন্ধি গাড়িচালকের ছিল না।
কিন্তু জুয়েলের ঘটনা ব্যতিক্রম।
ঠিক যেমন ন’বছর আগে ঘটেছিল ট্রাফিক সার্জেন্ট সমরেন্দ্রনাথ সাহা মণ্ডলের ক্ষেত্রে। ২০০৫ সালের ১৪ জুন তারাতলার মোড়ে ‘নো এন্ট্রি’ রাস্তায় ঢুকে পড়া লরিকে থামাতে চেয়েছিলেন সমরেন্দ্রনাথ। কিন্তু লরিটি এক পাশে দাঁড় করানোর অছিলায় হঠাত্ দ্রুত বেগে চালিয়ে ওই সার্জেন্টকেই পিষে দিয়েছিল চালক। সেই চালক মেহেদি হাসান ভাণ্ডারিকে ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আলিপুর আদালত।
জুয়েল সাহার মৃত্যুর ক্ষেত্রে মালবাহী লরির চালককে অবশ্য এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। শুধু মালবাহী লরিটিকে আটক করা হয়েছে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, চালকের নাম চন্দন সাউ এবং তার বাড়ি গার্ডেনরিচ এলাকায়।
জুয়েলের সহকর্মীদের একাংশেরও ধারণা, ২০১০ ব্যাচের এই অফিসারের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। ছিল কোনও দুরভিসন্ধি। পুলিশের চাকরির টানে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পেয়েও তাতে যোগ দেননি জুয়েল। চাকরি করতে করতে এম কম পাশ করেন তিনি। আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করার চেষ্টায় ছিলেন।
শোকার্ত স্ত্রী। সুদীপ ভট্টাচার্য।
বুধবার সকাল থেকেই পুলিশ অফিসারেরা হাজির ছিলেন আলিপুর থানা চত্বরে। যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকার ও ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদক-সহ লালবাজারের একাধিক শীর্ষকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। দুপুর পৌনে একটা নাগাদ খবর এল, কাঁটাপুকুর মর্গে জুয়েলের দেহের ময়না-তদন্ত শুরু হয়েছে। থানার ভিতরে অবশ্য ততক্ষণে ভেঙে পড়েছেন জুয়েলের মা-বাবা-বোন। নিয়ে আসা হয় জুয়েলের স্ত্রীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আনা হয় জুয়েলের মরদেহ।
মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পুলিশ কমিশনার সুরজিত্ করপুরকায়স্থ এবং বন্দরের বিধায়ক তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এর পরে ‘গান স্যালুট’। পুলিশের বিউগল, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল থেকে ছোড়া গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে কানে এসেছে মায়ের হাহাকার। পুলিশ কমিশনার বলেন, “কলকাতা পুলিশ যে কর্তব্য পালনে মৃত্যুকেও পরোয়া করে না, জুয়েল তারই উদাহরণ রেখে গেলেন।”
বিকেল পৌনে তিনটেয় জুয়েলের মরদেহ ও তাঁর পরিবারের গাড়ির কনভয় রওনা দিল কৃষ্ণনগরের বাড়ির দিকে। জুয়েলের এক সতীর্থ ধরা গলায় বললেন, “যাঁর সঙ্গে অন্য গাড়িকে পাইলট করা শিখলাম, আজ তাঁরই মরদেহের কনভয় পাইলট করতে হচ্ছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy