Advertisement
E-Paper

পুরভোটের মুখে বিশ কোটি ক্লাব-খয়রাতিতে

ভাঁড়ারে বড় টানাটানি। কিন্তু ভোটের তাগিদ বুঝি তার চেয়েও বড়! নবান্ন তাই ফের খয়রাতির ডালি উপুড় করছে। এবং এমন ভাবে, যার মধ্যে দলতন্ত্রের নিরাবরণ বহিঃপ্রকাশ দেখতে শুরু করেছে বিরোধীরা। সরকারি অর্থের এ হেন অপব্যবহার দেখে ত্রাহি রব প্রশাসনের অন্দরেও। রাজ্য সরকারের দাবি, তার সংসারে নিত্য অভাব। এতটাই যে, কর্মীদের বকেয়া ডিএ পর্যন্ত মেটানো যাচ্ছে না। এমনকী, দিন কয়েক আগে এক প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা বকেয়া বেতনের টাকা চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নবান্নের সামনে হত্যে দিয়েছিলেন।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২১

ভাঁড়ারে বড় টানাটানি। কিন্তু ভোটের তাগিদ বুঝি তার চেয়েও বড়! নবান্ন তাই ফের খয়রাতির ডালি উপুড় করছে। এবং এমন ভাবে, যার মধ্যে দলতন্ত্রের নিরাবরণ বহিঃপ্রকাশ দেখতে শুরু করেছে বিরোধীরা। সরকারি অর্থের এ হেন অপব্যবহার দেখে ত্রাহি রব প্রশাসনের অন্দরেও।

রাজ্য সরকারের দাবি, তার সংসারে নিত্য অভাব। এতটাই যে, কর্মীদের বকেয়া ডিএ পর্যন্ত মেটানো যাচ্ছে না। এমনকী, দিন কয়েক আগে এক প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা বকেয়া বেতনের টাকা চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নবান্নের সামনে হত্যে দিয়েছিলেন। টাকার আশ্বাস তো মেলেইনি, উল্টে পুলিশ দিয়ে তাঁদের আটকে থানায় পাঠানো হয়। অথচ আশ্চর্যের কথা, এই পরিস্থিতিতেও ক্লাবকে টাকা বিলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কার্পণ্য নেই! বিগত আড়াই বছরে গ্রাম-শহরের প্রায় ২৪০০ ক্লাবকে অন্তত ৬৪ কোটি টাকা ‘অনুদান’ দিয়েছে রাজ্য সরকার। এ বার পুরভোটের আগে ফের কপাল খুলছে কলকাতার অন্তত হাজার ক্লাবের। সরকারি কোষাগার থেকে তাদের দু’লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে।

অর্থাৎ, প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা। শুধু তা-ই নয়, যুবকল্যাণ দফতরের দেওয়া সেই টাকা কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলরদের হাত দিয়েই বিলি করার বন্দোবস্ত হয়েছে। পুর-সূত্রের খবর: তৃণমূলের ১০৫ জন কাউন্সিলরের প্রত্যেককে বলা হয়েছে নিজের নিজের ওয়ার্ডের দশটি ক্লাবের নাম আগামী বুধবারের মধ্যে পুরসভাকে জানাতে। তাঁদের সুপারিশ করা মোট ওই হাজারখানেক ক্লাবের বরাতেই শুধু সরকারি বদান্যতা জুটবে। আর বাদ পড়বে বিরোধী কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডের ক্লাবগুলো।

এই উদ্যোগ ঘিরেই এখন পুরমহলে বিতর্কের ঝড়। অভিযোগ উঠেছে, আগের দফায় বিধায়কদের মাধ্যমে ক্লাব-খয়রাতির টাকা বিলোনোর সময় অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হয়েছিল দলীয় আনুগত্য। এ বারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। পুর-সূত্রের খবর: গত সোমবার পুরভবনে মেয়র পারিষদদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন মেয়র। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি পুর-এলাকায় তৃণমূলের সমর্থনের ভিত যাচাই করার পরিকল্পনা সম্পর্কেও সেখানে আলোচনা হয়। স্থির হয়েছে, কোন কোন ওয়ার্ডে দলের অবস্থা খারাপ, কোথায় জিত সুনিশ্চিত ও কোথায় পরাজয়ের প্রবল সম্ভাবনা, তার আলাদা আলাদা তালিকা তৈরি হবে। অনেকেরই ধারণা, ক্লাবকে টাকা বিলির ক্ষেত্রেও সেই তালিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় যদিও ক্লাব-খয়রাতিতে পুর-কাউন্সিলরদের ভূমিকা অস্বীকার করেছেন। “এ সব বিধায়কদের মারফত দেওয়া হচ্ছে। পুরসভার এত টাকা কোথায়?” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন মেয়র।

মেয়র যা-ই বলুন, তাঁর দলেরই একাধিক কাউন্সিলর ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। ঠিক হয়েছে, টাকা পাওয়ার জন্য ছাপা দরখাস্ত তৃণমূল কাউন্সিলরেরা নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ডের দশটি ক্লাবকে দেবেন। পূরণ করা ফর্ম তাঁরাই আগামী বুধবারের মধ্যে পুরসভায় জমা দেবেন। গত শুক্রবার থেকে মেয়রেরই অফিসঘরে দরখাস্ত দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবারের মধ্যে প্রায় সব তৃণমূল কাউন্সিলর ফর্ম নিয়ে গিয়েছেন। বুধবার সকালে শুরু হয়েছে ‘ফিল আপ’ করা ফর্ম জমা নেওয়ার পালা। এ দিন ফর্ম জমা দিতে আসা এক কাউন্সিলরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কতগুলো ক্লাব পেলেন? তাঁর জবাব, “মুখ খোলা নিষেধ।”

বস্তুত নিজেদের ওয়ার্ডে দশটা ক্লাব আদৌ পাওয়া যাবে কি না, কোনও কোনও কাউন্সিলর তা নিয়ে ঘোর চিন্তায় রয়েছেন। এক জনের কথায়, “গোটা তিন চারেকের বেশি ক্লাবই পাওয়া যাচ্ছে না! জানি না, দশটা কী ভাবে পাব।”

এ ক্ষেত্রে বিস্তর ভুয়ো ক্লাবের নাম লিখিয়ে টাকা বিলির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরা। পুরো উদ্যোগটি নিয়েই তাঁরা প্রবল ক্ষুব্ধ। পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী, সিপিএমের রূপা বাগচীর আক্ষেপ, “সরকারি টাকায় দলতন্ত্রের এর চেয়েজঘন্য নজির আর কী হতে পারে!” কংগ্রেসের মালা রায়ের দাবি: গোড়ায় সব দলের কাউন্সিলরদের ফর্ম দেওয়ার কথা ছিল। পরে বলা হল, শুধু তৃণমূল কাউন্সিলরেরাই ফর্ম পাবেন। “ভাবতেও পারছি না, ভোট কেনার জন্য তৃণমূল সরকার এতটা নির্লজ্জ হতে পারে! মন্তব্য তাঁর। বিজেপি-র রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারির অভিযোগ, “আসলে টাকা দিয়ে ক্লাব কেনা হচ্ছে! আগামী বছর পুরভোট। ভোটে দলের হয়ে ক্লাবের সদস্যদের নামাতেই এই খয়রাতি।” রীতেশের দাবি, সাম্প্রতিক নানা ঘটনাবলির জেরে তৃণমূলের জন-সমর্থনে ধস নামছে। লোক ধরে রাখতে তাই তারা সরকারি টাকা ওড়াচ্ছে। তৃণমূলেরই এক কাউন্সিলরের মুখে প্রায় রীতেশের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি “ভোট তো আছেই। ইদানীং ক্লাবগুলো আরও অনেক কাজে লাগছে।” কী রকম?

ওঁর ব্যাখ্যা: এখানে হরেক প্রতিবাদ-সমাবেশে লোক জোগাড়ের ব্যাপারও কাজ করছে। “সারদা-কাণ্ডে তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতারের পরে তৃণমূলপন্থী বিশিষ্ট জনেদের মিছিল যতটা ভরেছে, তা নানা ক্লাবের সৌজন্যে। মদন গ্রেফতারের পরেও মিছিল বা প্রতিবাদ ধর্নামঞ্চের সামনে ক্লাবের ছেলেরা ভিড় জমাচ্ছে।’’ বলছেন তিনি। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্যসাধনের সঙ্গে তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর তাগিদও যথেষ্ট। কিন্তু যে দলের জনপ্রতিনিধির হাত দিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সরকারি অর্থে এই খয়রাতির যৌক্তিকতা সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠেছে নবান্নের অন্দরে। সরকারের নয়া উদ্যোগ দেখে প্রশাসনের একাংশ প্রমাদ গুনছেন। এক জনের বক্তব্য, “আগামী বছর কলকাতা-সহ রাজ্য জুড়ে পুর নির্বাচনের ঢল নামার কথা। শুধু কলকাতার ক্লাবের পিছনেই কুড়ি কোটি বেরিয়ে যাচ্ছে! ভোটের আগে অন্য পুরসভাতেও ক্লাবে ক্লাবে ঢালতে গেলে তো পাহাড়প্রমাণ টাকা লাগবে!”

তার সংস্থান কী ভাবে হবে, ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছেন না ওঁরা।

municipality election kolkata monetary help clubs mamata bandyopadhyay westbengal government
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy