Advertisement
E-Paper

মহিলার সম্মান বাঁচাতে এগোলেন শুধু এক জন যাত্রী

সকাল থেকে একের পর এক মেসেজ ঢুকছিল মোবাইলে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা-বার্তা পাঠাচ্ছিলেন চেনা-পরিচিতেরা। মহিলাদের জন্য বিশেষ এই দিনটার আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে সকাল সকাল একচোট তক্কোও হয়ে গিয়েছিল বিশেষ এক বন্ধুর সঙ্গে। মেয়েদের সম্মান করার আবার বিশেষ কোনও দিন হয় নাকি আমার যুক্তি ছিল এটাই।

ঋত্বিকা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ০০:৫৯

সকাল থেকে একের পর এক মেসেজ ঢুকছিল মোবাইলে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা-বার্তা পাঠাচ্ছিলেন চেনা-পরিচিতেরা। মহিলাদের জন্য বিশেষ এই দিনটার আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে সকাল সকাল একচোট তক্কোও হয়ে গিয়েছিল বিশেষ এক বন্ধুর সঙ্গে। মেয়েদের সম্মান করার আবার বিশেষ কোনও দিন হয় নাকি আমার যুক্তি ছিল এটাই। তখনও বুঝিনি দিন শেষ হওয়ার আগেই কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য।

সন্ধে ৬টা ১৫ মিনিটে কুঁদঘাট (নেতাজি) মেট্রো স্টেশন থেকে চাঁদনি যাওয়ার ট্রেনটা ধরেছিলাম। মহিলাদের আসন ফাঁকা না পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আসনে গিয়ে বসলাম। মেট্রো যখন টালিগঞ্জ, অর্থাৎ মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে ঢুকছে, তখন দেখলাম মাঝবয়সী এক মহিলা তাঁর ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়ে মহিলাদের আসন ছেড়ে আমার উল্টো দিকে প্রবীণ নাগরিকদের আসনে বসলেন। প্রথমে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। হঠাৎ শুনলাম আশপাশ থেকে মন্তব্য উড়ে আসছে, “মেয়েদের জায়গা ছেড়ে কেন এরা এখানে এসে বসে!”

কিছুক্ষণ যেতেই চোখে পড়ল মহিলার পাশে এসে সিটের হ্যান্ডেলে বেশ কায়দা করে হাত রেখে মোবাইলে খুটখুট শুরু করেছে এক যুবক। পরনে আকাশি নীল গেঞ্জি, ঢিলেঢালা কালো জিনস্। পিঠে ব্যাগ। মহিলা হঠাৎই বলে উঠলেন ‘‘সরে দাঁড়ান।” ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে এমন হাবভাব করল, যেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। আমি ও আমার পাশে বসা আর এক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে এ বার ওই মহিলা বললেন, “তখন থেকে উৎপাত করছে জানেন। ওখানে দাঁড়িয়েছিল, উঠে এলাম। পিছন পিছন এখানেও এসেছে।” ছেলেটির পাল্টা জবাব, “লেডিজ সিটের ওখানে মেয়েছেলেদের ভিড়। তাই এ দিকে এলাম। আপনি ব্যাটাছেলেদের এখানে এসে বসেছেন কেন?”

সিনিয়র সিটিজেনের সিট। তার আবার ব্যাটাছেলে-মেয়েছেলে হয় নাকি? কিছুটা হতভম্বই হয়ে গিয়েছিলাম ওই যুক্তি শুনে। মহিলার পাশে ওই সিটে অবশ্য তখনও কোনও প্রবীণ বসে ছিলেন না। যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁদেরই এক জন প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালেন এ বার। পরনে সাদা শার্ট, নীল জিনস্। হাতে একটা চওড়া বালা। সম্ভবত অবাঙালি। ছেলেটিকে রীতিমতো ধমক দিয়ে তিনি বললেন, “পাবলিক প্লেসে ইয়ার্কি হচ্ছে!” শুনে ছেলেটির পাল্টা জবাব, “কেন বে, তোর কেউ হয় নাকি?”

সংযম হারিয়ে প্রতিবাদী সেই যুবক এ বার ছেলেটির কলার ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। চিৎকার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। উঠে দাঁড়িয়েছেন পাশের মহিলাও। মহিলাদের আসন ছেড়ে এগিয়ে এসেছেন কলেজপড়ুয়া কিছু তরুণীও। ছোট্ট ছেলেকে জাপটে ধরে অঝোরে তখন কেঁদে চলেছেন অসহায় ওই মহিলা। অবাক হয়ে দেখছিলাম, অফিসের ব্যাগ কাঁধে ঝোলানো বেশ কিছু মুখ তখনও নির্বিকার। বিরক্তও! ‘‘কী সব উটকো ঝামেলা,’’ বলতে বলতে কেউ কেউ হাঁটা দিলেন পাশের কামরার দিকে।

এ দিকে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে ধস্তাধস্তি। প্রতিবাদী যুবকটির নাকে সজোরে ঘুুঁষি মারল ছেলেটি। ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলে এ বার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে এলেন কিছু লোক। ধরাধরি করে আলাদা করা হল দু’জনকে। প্রতিবাদী যুবকটির সাদা শার্ট ততক্ষণে ভেসে গিয়েছে রক্তে। চাপ চাপ রক্ত লাগল মেট্রোর দরজা, আসন, এবং মেঝেতেও। জলের বোতল বার করে তাঁর হাতে ধরানোর চেষ্টা করলাম। নিলেন না।

যতীন দাস পার্ক স্টেশনে তখন মেট্রো ঢুকছে। রক্ত ঝরেছে দেখে তখন কয়েক জন খুব তৎপর। দরজা খুলতে বীরপুঙ্গবকে ধাক্কা দিয়ে নামানো হল প্ল্যাটফর্মে। রেলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা কাছেই ছিলেন। তাঁদের জিম্মা করে দেওয়া হল তাকে। রক্ষীরা জানিয়ে দিলেন, আহত যুবকের চিকিৎসার ব্যবস্থা তাঁরাই করবেন। পরের স্টেশন আসতেই চোখ মুছতে মুছতে ছেলেকে নিয়ে নেমে গেলেন ওই মহিলাও। এগিয়ে চলল মেট্রো।

সকালের তর্কের কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। কী যেন বলছিল আমার বন্ধু, “আজ মেয়েদের কুর্নিশ জানানোর দিন!”

metro women harassment ritwika bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy