Advertisement
E-Paper

শহর জুড়ে মূষিক-রাজ, সমাধান জানে না পুরসভা

হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা থাকলে সমস্যাটা হয়তো এত দিনে মিটে যেত! কিন্তু কোথায় সেই বাঁশিওয়ালা? আর তাই শহর জুড়ে ‘তাদের’ অবাধ দৌরাত্ম্য। দিনের পর দিন কার্জন পার্ক থেকে রাইটার্স বিল্ডিং, ভিক্টোরিয়া থেকে এসএসকেএম হাসপাতাল, এমনকী বাসস্ট্যান্ড থেকে রেল স্টেশনে তাদের তাণ্ডব বেড়েই চলেছে। যার ফল হচ্ছে মারাত্মক। কখনও রাস্তায় গর্ত হচ্ছে, কখনও বা ফাটল ধরছে সেতুতে। হাজারো চেষ্টা করেও তাদের দমাতে পারছেন না পুরসভা ও পূর্ত কর্তারা। সবার কাছেই তারা এখন ‘আতঙ্কের’!

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৩০
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা থাকলে সমস্যাটা হয়তো এত দিনে মিটে যেত! কিন্তু কোথায় সেই বাঁশিওয়ালা? আর তাই শহর জুড়ে ‘তাদের’ অবাধ দৌরাত্ম্য।

দিনের পর দিন কার্জন পার্ক থেকে রাইটার্স বিল্ডিং, ভিক্টোরিয়া থেকে এসএসকেএম হাসপাতাল, এমনকী বাসস্ট্যান্ড থেকে রেল স্টেশনে তাদের তাণ্ডব বেড়েই চলেছে। যার ফল হচ্ছে মারাত্মক। কখনও রাস্তায় গর্ত হচ্ছে, কখনও বা ফাটল ধরছে সেতুতে। হাজারো চেষ্টা করেও তাদের দমাতে পারছেন না পুরসভা ও পূর্ত কর্তারা। সবার কাছেই তারা এখন ‘আতঙ্কের’!

এ শহরে খুদে চেহারার এই ‘আতঙ্ক’ হল মূষিকবাহিনী। দিনের পর দিন যারা বংশবিস্তার করে চলেছে মাটির নীচে। আর তাদের দৌরাত্ম্যে কালঘাম ছুটছে প্রশাসনের কর্তাদের।

মাটির নীচে মূষিককুলের এই সংসারের জেরেই গত বছরের ২৮ অক্টোবর এসপ্ল্যানেডে (ইস্ট) রাস্তার একাংশ জুড়ে ধস নেমে বসে গিয়েছিল। রেড রোডে তৈরি হয়েছিল গর্ত। এমনকী, বছরখানেক আগে ঢাকুরিয়া সেতুর কিছু অংশ বসে যাওয়ায় সেতু ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মহাকরণের কম্পিউটারের তার, বিদ্যুতের তার কেটেও কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল ইঁদুরবাহিনী। হাসপাতালেও তাদের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো।

কলকাতা পুরসভার রাস্তা দফতর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে, পুরনো রাস্তা বা অলিগলিতেই ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। এখানে রাস্তার তলার মাটি কাটার ফলে তা অনেক জায়গায় বসে গিয়েছে। উত্তর কলকাতার আর জি কর রোড সংলগ্ন ডালপট্টি, পোস্তা, বড়বাজার, মধ্য কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চল, স্ট্র্যান্ড রোড অঞ্চলে ইঁদুরের বেজায় উৎপাত। কিন্তু সেই উৎপাত রুখতে পুরসভার তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই বলেই জানিয়েছেন মেয়র পারিষদ (রাস্তা) সুশান্তকুমার ঘোষ। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, “এ বিষয়ে চটজলদি কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”

পূর্ত দফতরের কর্তারা জানান, গর্ত করে রাস্তার নীচে গিয়ে বাসা বাঁধে ইঁদুরেরা। ফলে মাটি আলগা হয়ে যায়। টানা বৃষ্টিতে পিচ নরম হয়ে গেলে গাড়ির চাপে ফাটল তৈরি হয়। তা দিয়ে ভিতরে জল ঢোকে গর্তে। এক সময়ে সেই গর্ত বড় আকার ধারণ করে ধস নামায়। অন্য দিকে, ঢাকুরিয়া সেতুর ফাটলের কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে বিশেষজ্ঞেরা দেখেছেন, বিভিন্ন গর্ত দিয়ে ভিতরে ঢুকে সেতুর তলার মাটি আলগা করে দিয়েছে ইঁদুরকুল। ফলে ভিত আলগা হয়ে যাওয়ায় সেতুটির বিভিন্ন অংশ বসে গিয়েছে। প্রাণী-বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, খুব সহজেই মাটির নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাতে পারে এই মেঠো ইঁদুরের দল।

আর এই সমস্ত ঘটনা থেকেই কলকাতা এক সময়ে ‘হ্যামলিন’ হয়ে উঠতে পারে বলেও বিস্ময় প্রকাশ করছেন প্রশাসনের কর্তা থেকে প্রাণী-বিশেষজ্ঞেরা। তা হলে কি এই মূষিকবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেই বাঁশিওয়ালাকেই দরকার?

জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা সুজিত চক্রবর্তী বলেন, “মূষিককুলকে একেবারে শেষ করে দেওয়া উচিত বলব না। তবে নিয়মিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে ওই মেঠো ইঁদুরদের বাড়বাড়ন্ত একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত থাকে।” উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মূষিককুলকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলছেন ‘নেচার এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি’র সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীও। তাঁদের সবার মতে, ইঁদুরকে মারতে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়, তা এখন আর এই মেঠো ইঁদুরদের ক্ষেত্রে কোনও কাজে লাগে না। কারণ, জিনগত ভাবে ওই ওষুধ মেঠো ইঁদুরদের ধাতে সয়ে গিয়েছে।

সুজিতবাবু জানান, বিষ খেয়ে ১০০টির মধ্যে ৪০টি ইঁদুর মারা যায়। আর ৩০টি প্রথমে কয়েক দিন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে থাকে। পরে কয়েকটি স্বাভাবিক হয়ে যায়। কয়েকটি মারা যায়। বাকি ৩০টির ওষুধ খেয়েও কিছুই হয় না। প্রাণী-বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য: “অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট বিশেষ ধরনের ট্যাবলেট। যা গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে গর্তের মুখ চেপে বন্ধ করে দিতে হয়। ওই ট্যাবলেট ভিতরে গিয়ে ভিজে মাটির সংস্পর্শে এসে গলে যায়। তা থেকে যে গ্যাস তৈরি হয়, তাতে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ইঁদুর মরে যাবে।” কিন্তু এই পদ্ধতি এক বার প্রয়োগ করে সব ইঁদুর মরে গিয়েছে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই পদ্ধতিতে মূষিককুলের বাড়বাড়ন্ত কমানো সম্ভব।

কোথা থেকে এল ইঁদুরের দল?

প্রাণী-বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ১৯৩০-’৪০ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ধেড়ে ইঁদুরের রমরমা ছিল। তারা থাকত হাইড্র্যান্টের মধ্যে। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে বদলে গেল আস্তানা। এই শহরের নীচে নিজেদের আর একটা শহর বানিয়ে ফেলল মেঠো ইঁদুরের দল। এদের লেজ শরীরের তুলনায় ছোট। পেটের দিকটা ধূসর রঙের। মূলত ধান খেতে বিচরণকারী এই ইঁদুর মাঠে গর্ত করে তাতে শস্য জমা করত। কিন্তু কৃষিজমি কমতে শুরু করায় এরা ক্রমশ কলকাতার দিকে চলে আসে। কারণ, যে কোনও পরিবেশেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে এই মেঠো ইঁদুরেরা। কলকাতা শহরের উপচে পড়া ডাস্টবিন এবং পথেঘাটে গজিয়ে ওঠা খাবারের দোকানের সৌজন্যে সহজেই প্রচুর চর্ব্য-চষ্য মেলে। এবং অন্য প্রাণীদের তুলনায় কম খাবার লাগে ইঁদুরদের।

আবার এই মেঠো ইঁদুররা বছরে ৬৪-৬৫টা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে বলেও জানাচ্ছেন প্রাণী-বিশেষজ্ঞরা। আবার তাঁরা বলছেন, “জন্মের দু’মাস পর থেকেই এরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়। তাই শহর জুড়ে ইঁদুরের রমরমা বেড়েই চলেছে।”

এক সময়ে কার্জন পার্কে এই ইঁদুরের প্রবল রমরমা ছিল। আশির দশকের পরে সেখান থেকে বেশি সংখ্যক ইঁদুর চলে গিয়েছে শহরের দক্ষিণ দিকে। প্রাণী-বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ইডেন গার্ডেন্সের বিস্তীর্ণ মাঠ পাওয়ায় সহজেই দক্ষিণে চলে যেতে পেরেছে ইঁদুরেরা। তবে উত্তরেও এদের বাড়বাড়ন্ত কম নয়।

কী ভাবে কমবে মূষিক-দাপট? বোধহয় একমাত্র সিদ্ধিদাতাই জানেন!

shantanu ghosh rat infested kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy