Advertisement
E-Paper

স্টান্স বদলে বাপি বাড়ি যা মারলাম, হাসছেন অশোক

এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! প্রমাণ রাখলেন শিলিগুড়ির সুভাষপল্লির ‘রতনদা’! লাগাতার হেরে-চলা কোনও দলের পরিচিত নেতারা অনেক সময়েই ভোটের যুদ্ধে নিজেদের গলা বাড়িয়ে দিতে চান না! তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ঠিক করেছিলেন, নিজেই ময়দানে নেমে গায়ে-গতরে খাটবেন। দেখবেন খেলাটা কতটা কঠিন!

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:০০
উদয়: জয়ের পরে অশোক ভট্টাচার্য। অস্ত: দলের হারের পরে গৌতম দেব। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক ও রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।

উদয়: জয়ের পরে অশোক ভট্টাচার্য। অস্ত: দলের হারের পরে গৌতম দেব। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক ও রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! প্রমাণ রাখলেন শিলিগুড়ির সুভাষপল্লির ‘রতনদা’!

লাগাতার হেরে-চলা কোনও দলের পরিচিত নেতারা অনেক সময়েই ভোটের যুদ্ধে নিজেদের গলা বাড়িয়ে দিতে চান না! তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ঠিক করেছিলেন, নিজেই ময়দানে নেমে গায়ে-গতরে খাটবেন। দেখবেন খেলাটা কতটা কঠিন!

খেলা শেষে ব্যতিক্রমী অশোক ভট্টাচার্যই মঙ্গলবার রীতিমতো দৃষ্টান্ত গড়ে দিলেন অন্যদের জন্য। ধারাবাহিক বিপর্যয়ে রক্তশূন্য সিপিএমের জন্য নতুন দাওয়াই এনে দিলেন তো বটেই। প্রবল পরাক্রমী শাসক দল তৃণমূলকে রোখার মন্ত্র সামনে এনে দল নির্বিশেষে সব বিরোধীর সামনেই নিয়ে এলেন নয়া উৎসাহের বার্তা। রাজ্যে পরবর্তী বিধানসভা ভোটের জন্য দৌড় শুরুর ঠিক মুখে।

অথচ এই অশোকবাবুই যখন শিলিগুড়ি পুরসভার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন, দলের ভিতরে-বাইরে কটাক্ষ ছিল যথেষ্ট। পুরমন্ত্রী ছিলেন। শেষে কাউন্সিলর হবেন? বাঁকা প্রশ্ন তুলতেন কেউ কেউ। অশোকবাবু অবশ্য বলতেন, ‘‘মানুষের জন্য কাজ করব! তার আবার ছোট-বড় কী আছে!’’ পুরভোটের বাক্স খোলার পরে অশোকবাবুর সেই নতুন ‘স্টান্স’ই বিপুল হাততালি কুড়োচ্ছে! পুরসভা দখলের মাইল ফলক থেকে তিনি আর মাত্র এক রান দূরে!

শিলিগুড়ির ৪৭ আসনের পুরসভায় বামেদের ঝুলিতে এ বার ২৩। সংখ্যারিষ্ঠতার ‘ম্যাজিক ফিগার’ থেকে মাত্র এক কম। অশোকবাবু আশাবাদী, নির্দল এক কাউন্সিলরের সমর্থন নিয়ে তাঁরাই গ়ড়বেন পুরবোর্ড। অন্য কারও সমর্থন লাগবে না। বোর্ড গড়ার জায়গায় যাওয়ার আগেই প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অবশ্য তৈরি করে ফেলেছিলেন, আর এক ‘শিলিগুড়ি-মডেল’! বিরোধীদের একজোট করে ভোটারদের নিরাপদে ভোট দেওয়াটা সুনিশ্চিত করেছিলেন তিনি। তার জোরেই ২০১১-য় ‘পরিবর্তনের হাওয়া’য় প্রায় খাদের ধারে চলে যাওয়া রাজনৈতিক ‘কেরিয়ার’কে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুলে রীতিমতো কাম-ব্যাকের জায়গায় এই বছর ষাতষট্টি। বামেরা বোর্ড গড়লে, তিনিই মেয়র।

এ বার ভোট ঘোষণার শুরুতেই গোড়াপত্তন প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর নতুন ইনিংসের। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলেছেন অশোক। সিপিএমের নবগঠিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে স্পষ্ট করে দেন, শিলিগুড়িতে শাসক দলকে টক্কর দেওয়ার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল তলানিতে যেতে দেবেন না। দক্ষিণবঙ্গে দলের কিছু নেতা-কর্মী শাসক দলের ‘লাগাতার সন্ত্রাসের’ মোকাবিলা করতে গিয়ে কিছুটা মুষড়ে পড়েছেন দাবি করে অশোকবাবু বৈঠকে জানিয়ে দেন, উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে শিলিগুড়ি থেকে দলের নেতা-কর্মীদের দক্ষিণবঙ্গে যেতে নিষেধ করবেন তিনি। পাছে, তাঁরাও মনোবল হারিয়ে ফেলেন! দলের অনেকে প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর এই ‘মনোভাব’ সমর্থন করেননি। অশোকবাবু অবশ্য তাতে ‘স্টান্স’ বদলাননি।

নতুন এই ‘স্টান্স’-এ কাজও হয়েছে। দলের নতুন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র অশোকবাবুর এই মনোভাবকে সমর্থন করে পাল্টা প্রতিরোধের ডাক দেন। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে ভোটের আগেই অশোকবাবুকে মেয়র পদপ্রার্থী বলে প্রচার শুরু করে সিপিএম।

তবে পুরনো ‘শিলিগুড়ি-মডেল’-এর জনকের পক্ষেও কাজটা গোড়ায় ততটা সহজ ছিল না। ২০০৯ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ৪৭ আসনের মধ্যে ৩০টি পেয়েছিল, তখনও মেয়র নিয়ে দু-দলের রেষারেষির সুযোগ নিয়েছিলেন অশোকবাবু। সে যাত্রায় তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে কংগ্রেসকে বোর্ড গড়ার কাজে সমর্থন করেছিল বামেরা। যা ‘শিলিগুড়ি মডেল’ হিসেবে রাজ্য রাজনীতিতে পরিচিত। কিন্তু বিধানসভায় হারার পরে, তাঁকে প্রকাশ্যে তাচ্ছিল্য করতে থাকে তৃণমূলের একাংশ।

তাঁর মন্তব্য বা সমালোচনার জবাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব কটাক্ষ করতেন, ‘‘উনি তো পঞ্চায়েতের সদস্যও নন, দলের জেলা সম্পাদকও নন, তা হলে ওঁর সমালোচনার জবাব দেব কেন?’’ দলের একাংশও ‘‘অশোকদার এ বার অবসর নেওয়া উচিত’’ বলে ফিসফাস শুরু করেন। এমন একটা সময়ে পুরভোটে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে অস্বস্তি হয়নি? হাসছেন ‘রতনদা’। বলছেন, ‘‘ভেবে দেখলাম, সামনে থেকে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। না হলে দলের কর্মীদের মনোবল বাড়বে না। তাই ভোটের ফল কী হবে সেটা না ভেবে ময়দানে নেমে পড়ি।’’

সেই থেকে অশোকবাবু কোথাও দলের কর্মী আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলেই ছুটেছেন। তৃণমূলের শত কটাক্ষেও পিছু হটেননি। দলের কেউ মামলায় জড়িয়ে জেলে গেলে তাঁর পরিবারের পাশে থেকেছেন। আইনি সাহায্য, টাকা জোগাড় করা, থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখানো, পুলিশকে সতর্ক করা—সবেতেই সামনে দেখা গিয়েছে তাঁকে। দলের কার্যালয় থেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন। ভোট-প্রক্রিয়া শুরুর পরে ৪৭টি ওয়ার্ডে চরকি-পাক দিয়েছেন।

কলকাতা পুরভোটে রক্তারক্তির পরে নিজের শহরে বিশাল মিছিল করেছেন। দলের নেতা-কর্মী তো বটেই, বিরোধী শিবিরের নেতা-কর্মীদের কাছেও বার্তা পৌঁছে দিয়ে অলিখিত জোট গড়ে মানুষের নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। ভোটের দিন সংযোজিত এলাকা-সহ কয়েকটি ওয়ার্ডে ‘বর্গি হানা’র আশঙ্কা রুখতে সব বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের জোট বেঁধে থাকার কৌশলের (নয়া শিলিগুড়ি মডেল) রচয়িতাও ছিলেন তিনিই। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘কলকাতার আদলে শিলিগুড়িতে বাইরের লোক আনিয়ে হামলার আশঙ্কা ছিলই। বিরোধী সব দল তো বটেই, তৃণমূলের নেতাদের একাংশও দলের ওই কাজে সায় দেননি। শান্তিপ্রিয় মানুষেরা রুখে দাঁড়ানোয় কাজ হাসিল করতে পারেনি বহিরাগতেরা।’’ শুধু অশোকের কৌশলেই কাজ হাসিল হয়েছে বলে মানতে নারাজ শহরের বিশিষ্ট জনদের অনেকেই। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মতে, কংগ্রেস-তৃণমূল বোর্ড ক্ষমতায় আসার পরে যে ভাবে নানা লুঠপাট, চেয়ার নিয়ে খেয়োখেয়ি, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ আবার বামেদের দিকে ঝুঁকেছেন। শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের একাধিক ব্যক্তিত্বের ধারণা, রাতারাতি নানা কায়দায় বিপুল বিত্তশালী হয়ে ওঠা কয়েক জন শাসক দলে ঢুকে প্রশাসনিক ক্ষমতায় বসতে যে ভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তাতে অনেকেই বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন। সে জন্যও শাসক দলের থেকে মুখ ঘুরিয়েছেন অনেকে।

মঙ্গলবার পুরভোটের ফল ঘোষণার পরে, দলের অন্দরে ও বাইরে চর্চায় অশোকবাবুর নতুন ‘স্টান্স’। আলোচনায় তাঁর নতুন ‘শিলিগুড়ি মডেল’। কী ভাবে অশোকবাবুর লড়াকু মনোভাবের কাছে নতি স্বীকার করে ১৭টি আসনে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে তৃণমূলের গৌতম দেবকে। যিনি দলের জেলা সভাপতি হিসাবে ‘ব্যর্থতার দায়’ স্বীকার করে নিয়েছেন।

ক্যামব্যাক হলে তো এমনই? সৌরভ-ভক্ত প্রাক্তন পুরমন্ত্রী হাসছেন। বলছেন, ‘‘স্টান্স বদলে দেখলাম, বাপি বাড়ি যা মারতে পারি কি না!’’

Municipal election Municipal election result Mamata Bandopadhyay Trinamool Tmc cpm Congress Bjp Siliguri Ashok Bhattacharya Kishor saha abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy