Advertisement
E-Paper

নিয়োগ: ‘সুপারিশকারী’দের মধ্যে কারা যেতেন পার্থের ‘চেম্বারে’? সিবিআইকে কী কী ‘তথ্য’ দেন তাঁর ওএসডি

নথিতে বলা হয়েছে, প্রবীর জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে ‘প্রভাবশালী’দের সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা সম্বলিত নথি পার্থই তাঁর হাতে তুলে দেন। একটি সিডি-ও দিয়েছিলেন তার সঙ্গে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৫
Share
Save

‘প্রভাবশালী’রা প্রাথমিকে নিয়োগে যে সব চাকরিপ্রার্থীর নাম ‘সুপারিশ’ করেছিলেন, তার তালিকা রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসেই তৈরি হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ‘প্রভাবশালী’দের অনেকেই পার্থের অফিসে যেতেন। নিজের ‘চেম্বারে’ বসে তাঁদের সঙ্গে বৈঠকও করতেন পার্থ। সিবিআইকে এমনটাই জানিয়েছিলেন পার্থের তৎকালীন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের নথি থেকেই তা জানা গিয়েছে। সেই নথি আনন্দবাজার অনলাইনের হাতেও এসেছে।

প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নাম জড়িয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী, বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষের। নাম জড়িয়েছে রাজ্যসভায় তৃণমূলের সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর এবং তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লারও। বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়ে সিবিআই যে নথি উদ্ধার করেছিল, সেই নথিতে তাঁদের নাম-পরিচয়ের উল্লেখ রয়েছে। তাঁরা যে সব চাকরিপ্রার্থীর নাম সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের নাম, রোল নম্বরও রয়েছে ওই নথিতে।

সিবিআইয়ের একটি নথি বলছে, গত বছরের ২৮ জুন বিকাশ ভবনে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া ওই সমস্ত নথি (নথিসংখ্যা ৩৯৩) প্রবীরকে দেখানো হয়েছিল। গত বছর ১৭ অগস্ট তলব করা হয়েছিল তাঁকে। সেই সময় পার্থের তৎকালীন ওএসডি তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন, চাকরিপ্রার্থীদের নাম সুপারিশের গোটা বিষয়টি সম্পর্কেই তিনি অবগত। নেতা-নেত্রীদের সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা পার্থের বাড়িতে বসেই তৈরি হয়েছিল।

সিবিআইয়ের নথিতে যে সব ‘প্রভাবশালী’র নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিধায়ক বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, শওকত মোল্লা, কোচবিহার জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ (ডিপিএসসি)-এর চেয়ারম্যান কল্যাণী পোদ্দার, প্রাক্তন বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা এবং রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। প্রবীর সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেছিলেন, ওই ‘প্রভাবশালী’রা প্রায়ই পার্থের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর অফিসে যেতেন। পার্থের চেম্বারে বৈঠকও করতেন তাঁরা। ওই বৈঠকে প্রবীর নিজে কখনও থাকতেন না। ফলে সেখানে কী হত, তা তাঁর অজানা বলেই দাবি করেছিলেন তিনি।

তদন্তকারী সংস্থার নথিতে বলা হয়েছে, প্রবীর জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ‘প্রভাবশালী’দের সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা সম্বলিত নথি পার্থই তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটি সিডি-ও দিয়েছিলেন তার সঙ্গে। সিডি-তেও ‘প্রভাবশালী’দের সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা ছিল। অন্তত তেমনটাই তাঁকে বলা হয়েছিল। প্রবীর দাবি করেছিলেন, তাঁকে ওই সিডি-টি মানিক ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দিতে বলেছিলেন পার্থ। প্রসঙ্গত, তৃণমূল বিধায়ক মানিকও নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এখন অবশ্য তিনি জামিনে মুক্ত।

সিবিআইয়ের নথি বলছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রবীরকে যে নথি তদন্তকারীরা দেখিয়েছিলেন, তাতে কিছু জায়গায় পার্থের ‘হাতের লেখা’ ছিল। কয়েক জন চাকরিপ্রার্থীর নামের পাশে ‘টিক’ চিহ্ন পার্থই দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন প্রবীর। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর তৎকালীন ওএসডি-র দাবি, পার্থ তাঁকে বলেছিলেন, ‘টিক’ চিহ্ন দেওয়া নামগুলিকে যাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তালিকার একটি প্রতিলিপি মানিকের কাছেও পাঠাতে বলেছিলেন পার্থ। প্রবীরের দাবি, তিনিই চাকরিপ্রার্থীদের নাম সম্বলিত ওই তালিকা থেকে পার্থের হাতের লেখা মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন শিক্ষা দফতরের এক অস্থায়ী কর্মী সুপর্ণা নিয়োগীকে। সুপর্ণা তা করেওছিলেন। যেখানে যেখানে পার্থের হাতের লেখা রয়েছে, সেখানে সেখানে ‘স্টিকি নোটস’ সেঁটে নিজের হাতে তা লিখেছিলেন সুপর্ণা। কিন্তু তা সর্বত্র করা হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় যে পার্থের হাতের লেখা থেকে গিয়েছিল, তা সিবিআই নথি দেখানোর পরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

প্রবীর সিবিআইকে জানিয়েছিলেন, যে ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর নামের তালিকা তৈরি হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে দু’জন বাদে কাউকেই তিনি চিনতেন না। যে দু’জনকে তিনি চিনতেন, তাঁদের নাম স্নেহাংশু ঘোষ এবং অরূপ নন্দী। তাঁরা প্রায়ই মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে অফিসে আসতেন বলে দাবি করেছিলেন প্রবীর।

সিবিআইয়ের উদ্ধার করা নথিতে ‘সুপারিশকারী’ হিসাবে দিব্যেন্দু, ভারতীর নাম নিয়েও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কারণ, দিব্যেন্দু এবং ভারতী দু’জনেই বর্তমানে বিজেপির নেতা-নেত্রী। তবে এ বিষয়ে বলে রাখা প্রয়োজন, ২০১৪ সালের প্রাথমিকের পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২২ সাল থেকে তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। যে বছরের পরীক্ষা নিয়ে এত বিতর্ক, সেই সময় দিব্যেন্দু এবং ভারতী দু’জনের কেউই বিজেপিতে ছিলেন না। পরে তাঁরা বিজেপিতে যোগ দেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর পদ্মশিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন তমলুকের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু। ভারতীও এককালে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপির টিকিটে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন ভারতী।

দিব্যেন্দুর নাম প্রকাশ্যে আসার পরেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তিনি কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। বলেছেন, ‘‘নো কমেন্টস।’’

আনন্দবাজার অনলাইন ভারতীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমি এসপি (পুলিশ সুপার) থাকাকালীন অনেক লোকের উপকার করেছি। কিন্তু সবটাই আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকে। কারও পরীক্ষাকেন্দ্র বদলের দরকার, যেখানে বলার বলেছি। কারও পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, রেজাল্ট বেরোচ্ছে না, যেখানে বলার বলেছি। কিন্তু কেউ পরীক্ষা দেয়নি বা পাশ করেনি, তাকে চাকরি দিয়ে দাও, এ রকম আমি কখনও বলিনি। আমার নাম যদি সিবিআই কোথাও পেয়ে থাকে, আমার বলায় কারও চাকরি হয়েছে বলে যদি সিবিআই জেনে থাকে, তা হলে সিবিআইয়ের উচিত ছিল আমার সঙ্গে কথা বলা। আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারত। আমার সঙ্গে কোনও কথাই বলল না। আমি কিছু জানতামই না। কিন্তু আমার নাম জড়িয়ে দিল। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ আমি মোদীজি (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী)-কে চিঠি লিখব। আজ (শুক্রবার) রাতেই লিখব। কারণ সিবিআই মোদীজির দফতরের অধীনস্থ। সেই সংস্থা এ রকম বেআইনি কাজ করছে, সেটা আমি ওঁকে চিঠি লিখে জানাব।’

সিবিআইয়ের নথিতে ‘সুপারিশকারী’ হিসাবে মমতাবালার নামও রয়েছে। তিনি যদিও বলেন, ‘‘এ সব কিছুই জানি না। পুরোটাই চক্রান্ত। অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত নই।’’

Partha Chatterjee Recruitment Case

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}