বিস্ফোরণস্থলে উপস্থিত পুলিশবাহিনী। ফাইল চিত্র।
বাজি তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণ নাকি মজুত রাখা বাজিতে বিস্ফোরণ?
বজবজের নন্দরামপুর দাশপাড়ায় রবিবার সন্ধ্যায় বাজি বিস্ফোরণে তিন জনের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পরেও এই প্রশ্নের উত্তর মিলল না। উল্টে এগরার খাদিকুল গ্রামের ঘটনার মতো এ ক্ষেত্রেও বিস্ফোরক আইনে মামলা না হওয়ার অভিযোগ উঠল। এগরার ঘটনায় পরবর্তী কালে নানা মহলের চাপ তৈরি হওয়ায় সিআইডি তদন্তভার নিয়ে বিস্ফোরক আইনে মামলা করে। এ ক্ষেত্রে সোমবারই তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ সদস্যের সিআইডি দল এ দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করে। কিন্তু কী করে এই বিস্ফোরণ হল এবং বিস্ফোরক আইনে কেন মামলা হল না, রাত পর্যন্ত সেই সব উত্তর মেলেনি।
জানা গিয়েছে, ঘটনাস্থল বজবজ থানার অন্তর্গত হওয়ায় সেখানে প্রথমে তিনটি মামলা রুজু করা হয়েছে। পরে পাশের মহেশতলা থানাতেও একটি মামলা রুজু হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৪ জনকে। পরে এঁদের মধ্যে ৩৩ জন আলিপুর আদালত থেকে জামিন পান। বেচু মণ্ডল নামে এক জনকে আট দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, বিস্ফোরণ হওয়া বাজিগুলি এই বেচুরই ছিল। এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ (অনিচ্ছাকৃত ভাবে মৃত্যু ঘটানো), ২৮৫ (অগ্নিসুরক্ষায় গাফিলতি), ২৮৬ (বিস্ফোরক জাতীয় কিছু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মানুষের জীবনহানি ঘটানো), ১৮৮ (সরকারি নির্দেশ অমান্য করে একই অপরাধ সংগঠিত করা ও তার জন্য এলাকায় অশান্তি) এবং দমকল আইনের ২৪ নম্বর (বাজি বিক্রির লাইসেন্স না থাকা বা লাইসেন্সের শর্ত অমান্য করা) ধারা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৪ সালের বিস্ফোরক আইনের কোনও ধারা এ ক্ষেত্রে যোগ করা হয়নি। যা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশের অভিযোগ, ‘ঘটনার পরে প্রচুর বাজি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। কিন্তু বাজি তৈরির উপকরণ নাকি একটাও পাওয়া যায়নি। বারুদ-সহ নানা উপকরণ সব এলাকার পুকুরে ভাসছে। কিন্তু পুলিশ পায়নি! বিস্ফোরক আইনে মামলা যাতে না করতে হয় সেই কারণেই পুলিশ বাজির উপকরণ ছেড়ে শুধু মজুত বাজি নিয়ে গিয়েছে।’ তাঁদের প্রশ্ন, বাজি তৈরি না হলে এত বাজি এলাকায় আসে কোথা থেকে? ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার সুপার রাহুল গোস্বামী বলেন, ‘‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ১১টা মামলা হয়েছে। ১০ হাজার কিলোগ্রাম বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এই ঘটনা ঘটার আগের দিনও ১৫০০ কিলোগ্রাম বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নিজে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। সিআইডি তদন্তভার নিয়েছে।’’ ঘটনাস্থলে যাওয়া সিআইডি আধিকারিক সায়ক দাশ বলেন, ‘‘তদন্ত একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মামলার ইনভেস্টিগেশন অফিসারের (আইও) সঙ্গেও এই সব বিষয়ে কথা বলা হবে।’’
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গোটা দাশপাড়া যেন আস্ত একটা ‘বাজি বাজার’। আর এই সব দৃশ্য লুকোতেই প্রবল তৎপরতা স্থানীয় ‘নেতা- দাদাদের’। যে গ্রামে রবিবার বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে প্রবেশের মুখের সব দিকের রাস্তা ঘিরে রাখা হয়েছে। পুলিশ এবং গ্রামবাসী ছাড়া অন্য কাউকে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়ির কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছিল না। তবু সিআইডি দলের সঙ্গে সেই পর্যন্ত পৌঁছনোর পর স্থানীয় এক বাসিন্দা দেখিয়ে দেন মৃত যমুনা দাশের বাড়ি। তিনিই জানান, বছর পঁয়ষট্টির যমুনার সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর মেয়ে, বছর পঁয়তাল্লিশের পম্পা ঘাটী এবং পম্পার মেয়ে বছর দশেকের জয়শ্রীর। বেঁচে গিয়েছে পম্পার বছর আটেকের ছেলে। ঘটনার সময় সে বাড়ির বাইরে খেলছিল। ওই বাসিন্দা বলেন, “বিস্ফোরণের পর যমুনা কিছুটা সময় বেঁচে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্থানীয় ইএসআই হাসপাতালে। তবে শেষরক্ষা হয়নি। অন্য দু'জনকে বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।’’ তিনি এ-ও জানান, যমুনার জামাই জয়দেব ঘাটী বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছেন। তাঁর বাজির ব্যবসাই ধরেছিলেন পম্পা। অনেকে বলছেন, ছাদে যেখানে বাজি ছিল, তার পাশেই নাকি ঠাকুর ঘর। সন্ধ্যায় ধুনো জ্বালাতে গিয়ে ফুলকি ছিটে এই কাণ্ড।
দেখা গেল, যমুনাদের একতলা বাড়ির ছাদের উপর কিছুটা অংশে পাঁচিল তুলে ঘর তৈরি করা হয়েছিল। উপরে দেওয়া হয়েছিল টিনের ছাউনি। নীচতলায় শাটার আঁটা বাজির দোকান। দেখা যায়, টিনের ছাউনির কিছুটা উড়ে গিয়ে পড়েছে দূরে জলাশয়ে। পাঁচিল ভেঙে হেলে পড়েছে পাশের জমিতে। পোড়া বারুদের গন্ধ এলাকাজুড়ে। ইতিউতি ছড়িয়ে বাজির খোল। শুধু এই বাড়িই নয়। রাস্তার দু'ধারে বাঁশের কাঠামোর উপর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট বাজির দোকান। ছাদের ঘরের নীচেও একের পর এক দোকান তৈরি হয়েছে রাস্তার ধারে। সেগুলির কোনও কোনওটি রবিবার রাতে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে পুলিশ। তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দোকানের ভিতরে থাকা বস্তা বস্তা বাজির প্যাকেট। পুলিশের দাবি, সব মিলিয়ে উদ্ধার হয়েছে ৩৭ হাজার কিলোগ্রাম বাজি। তার পরেও ইতি-উতি ছড়িয়ে রয়েছে তারাবাতি, তুবড়ির খোল। চোখে পড়ছে ‘চকলেট বোমার’ বাক্স। এমন প্রচুর বাজির প্যাকেটও রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে যার নাম অজানা।
আতঙ্ক বাড়ে এই রাস্তার ধারের পুকুরের দৃশ্য দেখলে। তাতে ভাসছে বারুদ। এক স্থানীয় বাসিন্দা সেই দেখিয়েই বললেন, ‘‘দোকানগুলি চোখের সামনে থাকে। কিন্ত আসল পরিস্থিতি বোঝা যায় এই এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরলে। সেগুলি বাজি তৈরির এক-একটা কারখানা। কিছু ঘটলে পুলিশ আসে, ধরপাকড় হয়। নয়তো সারা বছর চলেবাজির কারবার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy