Advertisement
E-Paper

দিনভর ‘অস্থির’ চরকিপাক অর্জুনের, মাটি কামড়ে ভাটপাড়া সামলালেন প্রতিপক্ষ দীনেশ

দীনেশ শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা নন। ভোট দেওয়ার ঝামেলাও ছিল না। ভোট শুরু হওয়ার আগেই কলকাতার বাড়ি থেকে তিনি পৌঁছে যান ভাটপাড়ায়।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ২১:৪২
এ ভাবেই সারাদিন অস্থির ভাবে ঘুরে বেড়ালেন অর্জুন সিংহ। ছবি: ভিডিয়ো গ্র্যাব।

এ ভাবেই সারাদিন অস্থির ভাবে ঘুরে বেড়ালেন অর্জুন সিংহ। ছবি: ভিডিয়ো গ্র্যাব।

দু’জনেই পোড় খাওয়া। একজন সম্পর্কে দল বা দলের বাইরেরঅনেকেই বলেন, দিল্লির ‘পাওয়ার করিডর’-র প্রতিটা ইট-কাঠ চেনেন তিনি। অন্যজন সম্পর্কে বলা হয়, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রন্ধ্র রন্ধ্র হাতের তালুর মতো চেনেন।

দুই হেভিওয়েট প্রার্থী— দীনেশ ত্রিবেদী বনাম অর্জুন সিংহের লড়াইয়ে ভোটের দিন ফাইনাল রাউন্ড কেমন হয় তা নিয়ে আগ্রহ ছিল সকলেরই। কমিশন থেকে শুরু করে দু’দলের কর্মীদেরও জানা ছিল, শিল্পাঞ্চলে তৃণমূল নেত্রীর ইজ্জতের লড়াইয়ে একইঞ্চিও জমি ছাড়বে না কেউ। আর তাই শিল্পাঞ্চলের ভোটের দিনের ঐতিহ্য মেনে রক্তপাতের আশঙ্কাও ছিল প্রবল। যদিও দিনের শেষে শিল্পাঞ্চলের আম জনতার কথায়,‘‘শিল্পাঞ্চলে এত শান্তিপূর্ণ ভোট শেষ কবে হয়েছে, মনে করা কঠিন।”

সেই শান্তির ভোটেই দুই প্রতিপক্ষকে ফাইনালের দিন দেখা গেল দুই ভিন্ন ভূমিকায়। শুরুটা দু’জনে এক সময়তেই করেছিলেন। সাতটা বাজার একটু আগেই ভাটপাড়া পুরসভা এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই ভোট দিতে চলে যান বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংহ। দীনেশ শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা নন। ভোট দেওয়ার ঝামেলাও ছিল না। ভোট শুরু হওয়ার আগেই কলকাতার বাড়ি থেকে তিনি পৌঁছে যান ভাটপাড়ায়।

বুথে বুথে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন দীনেশ ত্রিবেদী। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: আমডাঙায় এ বার বাঁশ নিয়ে পাল্টা তাড়া অর্জুন সিংহকে, দেখুন ভিডিয়ো​

‘বাহুবলী’ অর্জুন ততক্ষণে রওনা দিয়েছেন ব্যারাকপুরের মোহনপুরে। অভিযোগ, সেখানে তাঁর বুথ এজেন্টকে মেরে বাইরে বার করে দিয়েছে তৃণমূল কর্মীরা। সেখানে বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের বুথের দলীয় এজেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি বুথ ছেড়ে এগিয়ে গেলেন গ্রামের ভিতরের দিকে। ‘অভিযুক্ত’ তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ির সামনে পৌঁছতেই তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বচসায়। মুহুর্তের মধ্যে তা পৌঁছয় ধস্তাধস্তিতে। পুলিশও ছিল।অর্জুনের সঙ্গে ছিলেন তাঁর আধা সেনা দেহরক্ষীরাও। কিন্তু তার মধ্যেই ধস্তাধস্তিতে ঠোঁট ফাটে বিজেপি প্রার্থীর।

মোহনপুর পর্ব চলে বেশ খানিক ক্ষণ। সেখান থেকে এবার সটান তিনি নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম কলেজের পাশে বিজয়পুর বিদ্যাপীঠে। গাড়ি থেকে নামার পরই তৃণমূল কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়লেন। আওয়াজ ওঠে ‘অর্জুন সিংহ গো ব্যাক’। সেখান থেকে ভাটপাড়া পুরসভা এলাকারই ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে মনসাপল্লি প্রাথমিক বিদ্যাপীঠের সামনে। অভিযোগ, সেখানে বহিরাগতরা জড়ো হয়েছে বুথের সামনে। তিনি নিজেই শুরু করে দেন ‘বহিরাগত’-দের তাড়া করা। সেখানেও তাঁকে লক্ষ্য করে উড়ে আসে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান, সঙ্গে বাছাই করা বিশেষণ। ফিরে যাওয়ার মুখে মেজাজ হারিয়ে নিজেই তাড়া করেন অর্জুন। তাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়েও পড়ে ন একবার।আবারও সামান্য জখম হলেন। কিন্তু তাতেও হাল না ছেড়ে ফের নিজের তিনটি গাড়ি আর পিছনে ৩০টি সংবাদমাধ্যমের কনভয় নিয়ে ফের চরকিপাক। মাঝে একবার জামাকাপড় বদলে নেন অবশ্য।

আমডাঙায় রওনা হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অর্জুন সিংহ। ছবি: ভিডিয়ো গ্র্যাব।

অর্জুন যখন কার্যত টর্নেডোর গতিতে চরকিপাক মারছেন, তখন বসে নেই দীনেশও। তবে তাঁর মেজাজটা অর্জুনের ঠিক বিপরীত। বুথে বুথে ঘুরছেন। প্রায় প্রতিটা বুথে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন। অমায়িক কথাবার্তা। পথে পড়া মন্দিরে ঢুকে প্রণামও সেরে নিচ্ছেন। কিন্তু সবটাই বেশ ধীরে সুস্থে। অর্জুনের মতো ঘূর্ণিঝড়ের গতিতে নয়। মাঝে দলীয় কার্যালয়ে বিশ্রাম ও দুপুরের খাওয়াদাওয়াও সেরে নেন। তবে সারাদিনে একবার মোহনপুরের দলীয় পঞ্চায়েত সদস্য যাঁর বাড়ির সামনে অর্জুন হাজির হয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করা ছাড়া ভাটপাড়া বিধানসভা ছেড়ে বার হননি দীনেশ। প্রশ্ন করায় তাঁর জবাব,‘‘এটা প্রতিপক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা। তাই এখানে তো থাকতেই হবে।” তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলেন, আশঙ্কা ছিল অর্জুনের খাস তালুকে ভোটটাই আদৌ হবে না। তাই দিনভর মাটি কামড়ে ভাটপাড়াতে পড়ে ছিলেন দীনেশ। ওই বিধানসভা এলাকার ৮০ শতাংশ বুথে এক বারের বেশিও ঘুরেছেন তিনি। তবে দিনের শেষে দীনেশ জানান, তিনি খুশি। ভাটপাড়াতে মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন।

অন্যদিকে দীনেশের ‘রিল্যাক্স’ শরীরী ভাষার কণামাত্র ছিল না ভাটপাড়ার স্ট্রংম্যান অর্জুনের মধ্যে। শেষ বেলায় হঠাৎই ফোন পেয়ে চলে যান আমডাঙায়। তিনি পৌঁছতেই শুরু হয়ে যায় তৃণমূল-বিজেপি কর্মী সমর্থকদের বাঁশ ইট নিয়ে খণ্ডযুদ্ধ। দিনভর তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই বয়ে নিয়ে গিয়েছেন উত্তেজনার খোরাক। আর অর্জুনের সেই ‘অস্থির’ আচরণ দেখে তৃণমূল নেতৃত্বের কটাক্ষ, ‘‘উনি বুঝে গিয়েছেন তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তির কাছে তিনি শিশু। তাই হার নিশ্চিত জেনে এত অস্থির।’’ তৃণমূলের কথা শুনে যদিও মেজাজ হারাননি অর্জুন। দুপুর রোদে বীজপুরের হাজিনগরে দাঁড়িয়ে তাঁর সহাস্য উক্তি,‘‘ওরা জানে না কীভাবে নিজেরাই চক্রব্যুহে আটকে পড়েছে।’’ দিনের শেষে বিজয় মিছিলও বার করে ফেলেন তিনি! দিনভর অস্থিরতার সঙ্গে দিনের শেষে আত্মবিশ্বাস কী সত্যিই বেমানান?

সারাদিন এ রকম খোশ মেজাজেই ঘুরে বেড়ালেন দীনেশ ত্রিবেদী। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: ভোট তাণ্ডবে ব্যারাকপুরে রক্তাক্ত সাধারণ মানুষও​

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে দীর্ঘদিন ‘ভোট ম্যানেজ’ করা দুই বর্ষীয়ান এখনই দীনেশের শান্ত রিল্যাক্সড শরীরী ভাষাকে অ্যাডভান্টেজ বলে মানতে নারাজ। তাঁরা বলেন,‘‘দিনভর নজর করে দেখুন। অর্জুনের দৌড়টা কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের পানপুর মোড় থেকে সাহেববাগান মোড়ের মধ্যে আটকে। ওই এলাকাটার বেশি অংশটাই নৈহাটি বিধানসভার মধ্যে পড়ে। অর্জুনের অ্যাকিলিস হিল। তাই খুব হিসেব কষেই ওই এলাকায় নিজের বাহুবলী ইমেজ কাজে লাগিয়ে চরকিপাক মেরেছেন তিনি।”

ব্যারাকপুরের অতীতের স্ট্রংম্যান তড়িৎ তোপদারের নির্বাচন সামলানো এক ভোট ম্যানেজারের দাবি, ‘‘ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে তড়িৎ তোপদার, মুকুল রায় এবং অর্জুনের মতো ভোট ম্যানেজার কেউ নেই।’’ এলাকায় গুজব শোনা যায়, দুই মাথা তো আগেই একজোট হয়েছিল, তৃতীয় মাথা হিসাবে তড়িৎবাবুর ভোট করানোর অভিজ্ঞতাও নাকি যোগ হয়েছে অর্জুনের ঝুলিতে। তাই সোমবারের শান্তির ভোটে শিল্পাঞ্চলে শেষ হাসি কে হাসবে তা নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করতে নারাজ দুই দলের পোড় খাওয়া কর্মীরাও।

Lok Sabha Election 2019 Arjun Singh Dinesh Trivedi TMC BJP Bhatpara Barrackpore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy