মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলার রং বদলে দিয়েছিলেন স্লোগানটা তুলে। সেটা ২০১১ সাল। আট বছর পরে ফের সেই শব্দবন্ধে ফিরলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে ফের ‘পরিবর্তন’-এর ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হোলি উপলক্ষে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাড়োয়ারি ফেডারেশন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল নজরুল মঞ্চে। সেই মঞ্চ থেকেই দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পরিবর্তনের ডাক দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ‘পরিবর্তনের’ সঙ্গী হতে বাংলার মাড়োয়ারি সমাজকে আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস— আপনাদের কোনও সমস্যা হতে দেব না।
ছিল অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু পুরোপুরি অরাজনৈতিক রইল না মঞ্চটা। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের নাম করে কটাক্ষ ছুড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের শাসক দলের বিরুদ্ধে জোরদার আক্রমণই শানালেন। সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নিয়েই সরব হলেন সবচেয়ে বেশি। মিলেমিশে থাকার বার্তা দিলেন। ভাষণের শেষ পর্বে পৌঁছে পরিবর্তনের ডাক দিলেন।
ভাষণের শুরুতেই এ দিন মমতা সরব হন ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেশানোর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সেই ধর্মে বিশ্বাস রাখি না, যা রাজনীতির রং চড়িয়ে রক্তের হোলি খেলে। আমরা রক্তের হোলি খেলতে চাই না, আমরা ফুলের হোলি চাই।’’
আরও পড়ুন: বাবুলের গাওয়া বিজেপির থিম সংয়ে নিষেধাজ্ঞা কমিশনের
মাড়োয়ারি ফেডারেশনের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বার্তা কিন্তু বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আবহ তৈরি হলেই বাংলায় বসবাসকারী অবাঙালি সমাজ বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়বে— এমন তত্ত্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। সেই অবাঙালি সমাজের মঞ্চে দাঁড়িয়েই যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বা বিভাজনের চেষ্টার অভিযোগ তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো যায়, তা অনেক নেতাই ভাবতে পারেন না। কিন্তু ছকভাঙা রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বভাবসিদ্ধ। অতএব বিভাজনের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে এ দিন বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানালেন তিনি। মমতার কথায়, ‘‘কেউ কেউ দিল্লি থেকে এসে বলেন, এখানে দুর্গাপুজো হয় না। এটা কি সত্যি কথা? কতগুলো হয়? আমি মাড়োয়ারি ভাইবোনেদের জিজ্ঞাসা করছি— কতগুলো হয়? ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো হয় কি না? নবরাত্রি হয় কি না? ছট পুজো হয় কি না? তা হলে এরা কারা?’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রামমন্দিরকে নির্বাচনী ইস্যু বানাতে জানে, মন্দিরটা বানাতে পারে না— নাম না করে বিজেপির বিরুদ্ধে এই রকম কটাক্ষই এ দিন ছুড়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণেশ্বর, তারাপীঠ, তারকেশ্বর, গঙ্গাসগর-সহ এ রাজ্যের বিভিন্ন হিন্দু তীর্থস্থানের উন্নয়ন তাঁর সরকার কী ভাবে ঘটিয়েছে, এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সবের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তার পরে প্রশ্ন তোলেন, বারাণসীতে (মোদীর কেন্দ্র) ঠিক কতটা উন্নয়ন হয়েছে? কটাক্ষের সুরে তিনি বলেন, ‘‘দেশে তো অনেক মন্দির রয়েছে। কটা হয়েছে? একটা রামমন্দিরও তো বানাতে পারেননি। শুধু নির্বাচনের ইস্যু বানিয়েছেন।’’
ভাষণের একটা পর্বে পৌঁছে অবশ্য এ দিন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহকে নাম করে আক্রমণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইব, আপনারা কখনও পুজো করেন। শুধু একটা সিঁদুরের তিলক কাটলেই পুজো হয় না। পুজোর মন্ত্রের কম্পিটিশন হোক। অমিতবাবু এবং মোদীবাবু, চলে আসুন আমার সঙ্গে। কে কত সংস্কৃত মন্ত্র জানেন, আমি দেখাচ্ছি।’’
আরও পড়ুন: সমঝোতার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় কংগ্রেসকে, ৪টে বাদে সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা বামেদের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও এ দিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, দক্ষিণ কলকাতার বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী। ফিরহাদ নিজের ভাষণে, অসমের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। সেখান থেকে বাঙালি, মাড়োয়ারি, হিন্দিভাষী-সহ সব অ-অসমিয়া লোকসজনকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ তোলেন। ফিরহাদ সতর্কবার্তা দেওয়ার সুরে আশঙ্কা প্রকাশ করেন— আজ হিন্দু-মুসলিমে গোলমাল লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে, এর পরে বাঙালি-মাড়োয়ারির মধ্যে গোলমাল লাগানো হবে। অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা তথা প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীনেশ বজাজও নিজের ভাষণে বোঝানোর চেষ্টা করেন, মাড়োয়ারিরা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে।
ফিরহাদ বা দীনেশদের বক্তব্যের অনুরণনও এ দিন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বা দীনেশ বজাজদের কোন কোন পদ সরকার দিয়েছে, তা উল্লেখ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনিয়োগের স্বার্থে বিদেশ সফরের সময়ে সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, সঞ্জয় বুধিয়া-সহ অন্য অনেক অবাঙালি শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীকে যে তিনি সঙ্গে নিয়ে যান, সে কথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু মাড়োয়ারি সমাজের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা বা মাড়োয়ারি সমাজের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তাঁর দেখাসাক্ষাতের সঙ্গে ভোট বা রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মাড়োয়ারি ভাইবোনেদের সঙ্গে ভোটের রাজনীতি করার দরকার আমার পড়ে না, তাঁরা এমনিতেই আমাদের ভোট দেন। যাঁরা মন থেকে দেন, তাঁদের কাছে আমরা ভোট চাইব কেন?’’
দেশের নেতাকে ভালবাসার বদলে মানুষ এখন দেশের নেতাকে ভয় পান— এই রকম মন্তব্যও এ দিন শোনা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। তার পরেই পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘এই যে পরিস্থিতি, এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। এই পরিবর্তন হলে, আপনাদের মতো ব্যবসায়ীদের কোনও সমস্যা হবে না। আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির কোনও সমস্যা হবে না।’’ তিনি বলেন, ‘‘মাড়োয়ারি সমাজ, গুজরাতি সমাজ, পঞ্জাবি সমাজ— সব আমাদেরই সমাজ। আপনাদের উপর কোনও অত্যাচার হতে দেব না। হোলিতে এটা আমার প্রতিশ্রুতি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy