Advertisement
E-Paper

নতুন মাঠে ‘গোল’ বাঁচানোই চ্যালেঞ্জ

নদিয়া জেলায় এই লোকসভা আসন ধরে রাখার লড়াই চালাচ্ছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। জোট-সাফল্যের ইতিহাস ভুলে সাবালকের জয় চাইছে বিজেপি। সিপিএম চাইছে হৃতক্ষমতা ফিরে পেতে।

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:০২
চার মূর্তি, কৃষ্ণনগর।

চার মূর্তি, কৃষ্ণনগর।

রাজার বাড়ি, ঘুর্ণির পুতুল, কাঁসা শিল্প, সরভাজা-সরপুরিয়া সবই আছে। চলতি ভোট-যুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ বিশ্বাসের প্রকট ফারাকও রয়েছে। তাই তো তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস বলছে “এই নির্বাচন অস্তিত্ব রক্ষার”, অথবা “প্রকৃত পরিবর্তন এ বার হবে”, কিংবা “ওরাই তো খাল কেটে কুমীর এনেছে”, কখনও বা “আমরাই একমাত্র বিকল্প”— প্রচারের এই ঘুর্ণিতে সরগরম ঘুর্ণি পুতুলের দেশ কৃষ্ণনগরের ভোটের হাওয়া।

নদিয়া জেলায় এই লোকসভা আসন ধরে রাখার লড়াই চালাচ্ছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। জোট-সাফল্যের ইতিহাস ভুলে সাবালকের জয় চাইছে বিজেপি। সিপিএম চাইছে হৃতক্ষমতা ফিরে পেতে। আর জনভিত্তি ও সাংগঠনিক শক্তির প্রকৃত ছবিটা পরখ করতে চাইছে কংগ্রেস।

তবে এ বারের লড়াইটা যে কঠিন, তা মানছেন সকলেই।

একটা সময়ে কংগ্রেসের প্রভাব থাকলেও দীর্ঘ বছর ধরে এই আসনটি দখলে রেখেছিল বামেরা। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (জলু) কৃষ্ণনগরে জিতলেও ২০০৪ সালের ভোটে আসনটি ফিরে পায় সিপিএম। অবশ্য তত দিনে তৃণমূল নিজের সংগঠন গোছাতে শুরু করে দিয়েছে। আর সময়ের সঙ্গে সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় হয়েছে সিপিএম এবং কংগ্রেসের। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তথাকথিত রাজনৈতিক মুখ না হলেও অভিনেতা তাপস পালকে প্রার্থী করে কৃষ্ণনগরে বাজিমাত করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালের প্রবল মোদী হাওয়াও ঘাসফুলকে উড়িয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘দাদার কীর্তি’ শাসক দলের অস্বস্তি বাড়ায়। সংস্কৃতিমনস্ক কৃষ্ণনগরের ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে ‘রেপ’ করানোর হুমকি দিতে শোনা গিয়েছিল বিদায়ী সাংসদ তাপসকে। চিটফান্ড-কাণ্ডে বছর তিনেকের জন্য সাংসদের হাজতবাস দলের অস্বস্তি আরও বাড়ায়।

এই পরিস্থিতিতে নদিয়ার করিমপুরের বিধায়ক মহুয়া মৈত্রকে প্রার্থী করেছেন নেত্রী। রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, এই সিদ্ধান্তে এক তিরে কার্যত দুই শিকার করতে চেয়েছেন মমতা। এক, মহিলা প্রার্থী দিয়েই মহিলাদের উদ্দেশে তাপসের অপমানসূচক মন্তব্যে তৈরি ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করেছেন নেত্রী। দুই, বিদেশে পড়াশোনা এবং কর্পোরেট সংস্থার উঁচু পদে চাকরি করা বলিয়ে-কইয়ে কেতাদুরস্ত মহুয়াকে ওজনদার প্রার্থী হিসেবেই তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। পূর্বসূরির কীর্তি সম্পর্কে সেই মহুয়ার সোজাসাপটা জবাব, “ঘটনাটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ছিল। তবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সেই অস্বস্তি আমাকে বুঝতে দিচ্ছে না।” আর দলের জেলা নেতৃত্বের বক্তব্য, “তাপস প্রার্থী হলে আবারও জিততেন।”

কিন্তু কোন রসায়নে?

ভোটের পাটিগণিত বলছে, এই আসনে সংখ্যালঘু ভোটের হার কমবেশি ৪৩%। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তেহট্ট, পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, চাপড়া, কৃষ্ণনগর উত্তর এবং কৃষ্ণনগর দক্ষিণ— কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের অন্তর্গত এই সাতটি আসনে ন্যূনতম ৪৪% ভোট পেয়েছিল শাসক দল। সর্বোচ্চ প্রায় ৫০% ভোট ছিল দলের দখলে। যা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলের পক্ষে থাকা বিধানসভাভিত্তিক ভোট শতাংশের থেকে ঢের বেশি। এই তত্ত্বেই জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশংকর দত্ত বলছেন, “জিতব আমরাই। কৃষ্ণনগর নিয়ে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সিপিএম বিলুপ্তপ্রায়। আর কংগ্রেস নিয়ে ভাবার কী রয়েছে!”

দিনরাত এক করে প্রচার করছে সব দল। প্রতিটি পঞ্চায়েতে যাচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া। ২২-২৭ এপ্রিল হবে প্রচারের ‘ফাইনাল টাচ’। কড়া গরমে গলদঘর্ম হয়েও একেবারে নিজের কায়দায় জনসংযোগের খামতি রাখছেন না তিনি। বিজেপি-কে প্রধান প্রতিপক্ষ না-মানলেও সিপিএম-কে কিছুটা গুরুত্ব দিচ্ছেন মহুয়া। প্রার্থীর কথায়, “মোমের পুতুল নই। করিমপুরে রাঘববোয়াল মেরে এখানে এসেছি। সিপিএমকে দুর্বল ভাবছি না। মরা হাতির দাম লাখ টাকা।” জেলায় শাসক দলের অন্দরের লড়াইকে আমল না-দিয়ে মহুয়া বলেন, “দলের সকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোক কি না, এটা তা প্রমাণ করার সময়।” আর তাঁর জেলা সভাপতি বলছেন, “৪২টি কেন্দ্রেই প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

৭০-৭২% এলাকাকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। ভোট করানোর অন্যতম দায়িত্বে থাকা বিজেপি নেতা পার্থ চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, ‘‘পুরো বই পড়ার পরে বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর তৈরিতে চলছে রিভিশন।’’ তিন তালাককে হাতিয়ার করে দলের নেতারা মনে করছেন, আলোকপ্রাপ্ত সংখ্যালঘু মানুষের সমর্থনও পাবেন তাঁরা। পাশাপাশি, যুব সম্প্রদায় এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে ‘বিরক্ত’ ভোটারদের এক জোট করতে চাইছে দল। হিন্দুপ্রধান এবং সমমনোভাবাপন্ন এলাকাগুলিতে চলেছে রামসেবকদের প্রচার। এই কেন্দ্রে ব্যক্তিগত ইমেজ থাকা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সচেতন ভাবেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। জাতীয় দলের এক সময়ের গোলরক্ষক কল্যাণ চৌবে তাই সতর্ক।

প্রচারে মহুয়া বলছেন, “আমি সেন্টার ফরওয়ার্ডে খেলছি। গোল বাঁচান গোলরক্ষক।” কল্যাণের জবাব, “২৩ মে স্পষ্ট হবে কে গোল খেল, আর কে বাঁচাল। ফুটবল খেলে বড় হয়েছি। টিম-গেম আমার নখদর্পণে।”

সিপিএম প্রার্থী শান্তনু ঝা ছুটছেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সিপিএমের আশা, বিজেপিতে যাওয়া এবং দলের থেকে মুখ ঘোরানো কর্মী-সমর্থকদের একাংশকে এ বার অন্তত ঘরে ফেরানো যাবে। তবে ভোট-পাটিগণিতের চর্চার বদলে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলছেন, “বিজেপি-কে হাত ধরে আনছে তৃণমূল। প্রতিযোগিতামূলক মেরুকরণ চলছে। এ বার সেফোলজিস্টদেরও কেউ ফলাফল বলতে পারবেন না। বিরক্ত হয়ে যাঁরা ভোট দেন, তাঁদের ভোট একমুখী হবে না।” শান্তনুবাবুর কথায়, ‘‘মানুষ হতাশ হয়েছেন। আমাদের সমর্থন বাড়ছে।’’

তৃণমূল বা বিজেপির মতো সংগঠিত, আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর ভোট পরিচালনা পদ্ধতি নেই কংগ্রেসের। সংগঠনও খুব শক্তিশালী নয় এখন। তবে নির্বিঘ্নে ভোট হলে অঙ্ক বদলানোর আশায় আছে দল। রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা কংগ্রেস প্রার্থী ইন্তাজ আলির কথায়, “সকলে যাতে ভোট দিতে পারে, তার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। সব জায়গায় বুথ এজেন্ট দেওয়া যাবে।”

বিগত বছরগুলিতে তিনটি সরকারি কলেজ, প্রতি ব্লকে আইটিআই, জল প্রকল্প, রাস্তা, সেতু, কুটির শিল্পে সহজ ঋণ প্রকল্প ইত্যাদি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া মৃৎশিল্পী সুবীর পালের কথায়, ‘‘শিল্পীদের কাজের পরিধি বেড়েছে। তাই আয়ও বেড়েছে। তবে এখানে আর্ট-কলেজ বা স্কুল হলে ভাল হত।’’ তবু গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট না-দিতে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। রয়েছে ক্ষোভ-উষ্মাও। স্থানীয়দের মধ্যে শাসক-নেতাদের একাংশের ‘অহমিকা’ও বিরক্তি উৎপাদন করেছে। তবে তা সবই রীতিমতো প্রচ্ছন্ন। সীমান্তবর্তী জেলার এই আসনে মেরুকরণ তত্ত্বের প্রতিফলনও স্পষ্ট।

কী হবে নির্বাচনে?

পথের ধারে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই প্রবীণ জনৈকের জবাব, “বিশ্বকাপের দলে ঋষভের বদলে অভিজ্ঞ দীনেশকে নিয়ে ভালই করেছে ক্রিকেট বোর্ড।”

Lok Sabha Election 2019 Nadia CPM Congress BJP TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy