Advertisement
E-Paper

আড়াআড়ি ভাগ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল মেদিনীপুরে

গাড়িতে, কখনও বাইকে আবার সময় বিশেষে পায়ে হেঁটে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ছুটছেন বর্ষীয়ান নেতা মানস ভুঁইঞা। সঙ্গে ‘জান লড়িয়ে’ খাটছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতিও।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ২০:৪৮
কীভাবে আবাস যোজনার টাকা ছিনতাই হয়েছে, শোনাচ্ছেন কেশিয়াড়ির মুগলি হেমব্রম।

কীভাবে আবাস যোজনার টাকা ছিনতাই হয়েছে, শোনাচ্ছেন কেশিয়াড়ির মুগলি হেমব্রম।

দৃশ্য ১

জাতীয় সড়ক থেকে ধর্মার মোড় দিয়ে মেদিনীপুর শহরের দিকে ঢুকতেই বেশ অচেনা একটা অনুভূতি হচ্ছিল। সবটাই চেনা, কিন্তু অচেনা ঠেকছে। প্রায় সব বাড়ির মাথায় লম্বা ডান্ডার আগায় ঝান্ডা। লেখা জয় শ্রী রাম, নয়তো জয় বজরংবলী। রাস্তার দু’ধারে তিনকোনা গেরুয়া ঝান্ডার চেইন। শুধু রাস্তা নয়, টোটো-রিকশার হাতলেও ছোট ছোট গেরুয়া ঝান্ডা। হঠাৎ করে মনে হল যেন উত্তর ভারতের কোনও মন্দির-শহর বা তীর্থক্ষেত্রে চলে এসেছি! সিপাই বাজারের মতো কোথাও কোথাও আবার একই কায়দায় লম্বা বাঁশের মাথায় উড়ছে চাঁদ-তারা আঁকা সবুজ পতাকা। এলাকাটি সংখ্যালঘু বসতি বলে পরিচিত।

গোটা শহর জুড়ে এই ছবি দেখে গোলকুঁয়া চকে এক বন্ধু সুজয়কে প্রশ্ন করতেই সে রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠে জবাব দিল,‘‘এই হচ্ছে তোমাদের সমস্যা। ভোটের বাজারে এর পিছনেও ভোটের গন্ধ খোঁজার চেষ্টা।” সুজয়ের দাবি, এই পতাকার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। বহু সক্রিয় তৃণমূল বা সিপিএম কর্মীর বাড়িতেও রয়েছে এ রকম ঝান্ডা। শুধু সুজয় নয়, আরও অনেকের কথাতেও একই সুর,‘‘এটা আমাদের ধর্মের প্রতীক। হিন্দুত্বের প্রতীক। এর সঙ্গে দল বা রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।” কোতোয়ালি থানায় পরিচিত এক পুলিশ আধিকারিক বলছিলেন, ‘‘গত দু’বছরে শহরে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ধর্মীয় কারণে সংঘর্ষ হঠাৎ করেই গোটা শহরটাকে ধর্মের ভিত্তিতে আড়াআড়ি ভাগ করে দিয়েছে। বাড়ির মাথায় ঝান্ডা যেন একটা অস্তিত্বের প্রতীক।”

আড়াআড়ি ভাগের অন্যপ্রান্তে একই ভাবে মরিয়া অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা রয়েছে সবুজ পতাকা তুলে জানান দেওয়ার মধ্যেও। কেবল মেদিনীপুর নয়, একই প্রবণতা চোখে পড়ে খড়্গপুর বা এলাকার বিভিন্ন বসতিতেও।

শালবনির ভোগলু মাহাত এবং তাঁর স্ত্রী আরতি। পিছনে সদ্য তৈরি হওয়া বজরঙ্গবলী মন্দির।এ রকমই জঙ্গলমহলের আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে হনুমান মন্দির।

আরও পড়ুন: চাপের মুখে ভোটষষ্ঠীতে ৭৭০ কোম্পানি, জঙ্গল মহলে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট কেন্দ্রীয় বাহিনীকে​

দৃশ্য ২

জাতীয় সড়ক থেকে লাইন দিয়ে লরি ঢুকছে শালবনিতে জিন্দালদের কারখানাতে। ইস্পাত নয়। প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানায় এখন তৈরি হয় সিমেন্ট। বাঁদিকে কারখানার মূল ফটকটা ফেলে এগিয়ে গেলেই গ্রাম। রাস্তায় সিমেন্টের ধুলো। পাশের ধান খেতেও সদ্য পেকে ওঠা ধানের শিসের উপর সেই ধুলোর প্রলেপ। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটা মন্দির তৈরি হচ্ছে। বেশ বড়সড়ই। মন্দিরের দেওয়াল এখনও তৈরি না হলেও কংক্রিটের ছাদ তৈরি হয়ে গিয়েছে। আর তার তলায় পবণপুত্র হনুমানের পেল্লায় মূর্তি। সেখানেই দেখা হয়ে গেল ওই গ্রামেরই বাসিন্দা ভোগলু মাহাত এবং তাঁর স্ত্রী আরতির সঙ্গে। ভোগলু আগে চাষ-আবাদই করতেন নিজের বিঘে দুয়েক জমিতে। কারখানা তৈরির সময় সেই জমি চলে যায় কারখানায়। জমির দাম বাবদ লাখ তিনেক টাকা পেয়েছেন। কিন্তু চাকরি পাননি। তিনি বলেন,‘‘ওরা চাকরি দেবে বলেছিল। কিন্তু সেই লোহার কারখানাই তো হল না। চাকরিও হল না।” তবে মাসখানেক আগে ভোগলুর এক ছেলে অবশ্য একটা চাকরি পেয়েছেন। কারখানায় ঝাড়পোছের জন্য একটি ঠিকাদারি সংস্থার অধীনে কাজ। মাইনে পাঁচহাজার টাকা।

ভোগলু মাহাত একা নন। শালবনি কারখানার জমিদাতা প্রায় ১২০০ পরিবারের খুব কম অংশই জমি দেওয়ার শর্ত অনুযায়ী চাকরি পেয়েছেন। সে চাকরিও অস্থায়ী। ঠিকাদারের অধীনে দিন মজুরি হিসাবে কাজ। তাই শালবনির কারখানা হলে যে গোটা এলাকার চালচিত্র বদলে যাবে, সেই স্বপ্নটা আর বাস্তবায়িত হয়নি এ তল্লাটের মানুষের কাছে। সে কথাই বলছিলেন শালবনির জমিদাতা কমিটির সভাপতি পরিষ্কার মাহাত। তাঁর পরিবার সব মিলিয়ে দিয়েছে প্রায় দু’একর জমি। তিনি বলেন,‘‘এই কারখানাও কতদিন চলবে তা নিয়েও সংশয় আছে। তারপর?” জমিদাতাদের চোখে সংশয় আর আশঙ্কা। জিন্দালের সিমেন্ট ভরসা জোগাতে পারছে না তাঁদের। তবে চলে আসার মুহূর্তে পরিষ্কার এবং তাঁর সঙ্গী বংশীবদন মাহাতর একটা উক্তি ভোলার নয়,‘‘মানসবাবু তো আমাদের ঘরের লোক। অনেক দিন ধরে দেখছি। তবে এটা তো মানেন, একটা সর্বভারতীয় দলের রাজ্য সভাপতি ধারে-ভারে তো একটু এগিয়ে থাকবেনই। তাঁকে একটু বেশিই ভরসা করবে মানুষ।”

আরও পড়ুন: ভারতীর বিরুদ্ধে মামলা করল পুলিশ​

দৃশ্য ৩

কেশিয়াড়ি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। বেগমপুর অঞ্চল। মূলত জনজাতির বাস। তাঁদেরই একজন মুগলি হেমব্রম। সদ্য বিধবা মুগলি কৃষি মজুরের কাজ করেন। বছরের অর্ধেক সময়ই কাটে বাড়ি থেকে দূরে পূবের(বর্ধমান,হাওড়া) মাঠে ধান কেটে, চাষের কাজ করে। একমাত্র মেটে ঘরটা ফিবছর ঝড়-জলে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। আবেদন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকার জন্য। মুগলি বলেন,‘‘যে দিন প্রথম দফার টাকা এল, সে দিন এলাকার এক তৃণমূল নেতা আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে গেলেন। ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিল প্রথমবার। সেই টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দিয়ে কাগজে সই করিয়ে নিয়ে ১০ হাজার টাকা নিয়ে নিলেন। বলল পার্টিকে দিতে হবে ওই টাকা।” এ অভিজ্ঞতা শুধু মুগলির নয়। তাঁর পড়শি ডাক্তার মান্ডি থেকে শুরু করে রূপবারি মান্ডিরও এক অভিজ্ঞতা।আবাস যোজনার টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকেই ‘ছিনতাই’ হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের পার্টি তহবিলের নামে।

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার জবাবও দিয়েছিলেন মানুষ। গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশিটাই ভোটে জিতে দখল নেয় বিজেপি। বিজেপির ব্লক সভাপতি সনাতন দলুই বলেন,‘‘ভোটে জেতার পরেও গায়ের জোরে অনেক জায়গায় আমাদের বোর্ড তৈরি করতে দিচ্ছে না তৃণমূল।”

গাড়িতে, কখনও বাইকে আবার সময় বিশেষে পায়ে হেঁটে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ছুটছেন বর্ষীয়ান নেতা মানস ভুঁইঞা। সঙ্গে ‘জান লড়িয়ে’ খাটছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতিও। পুরো দায়িত্বই তাঁর ঘাড়ে। কালীঘাট থেকে স্পষ্ট নির্দেশ—ফল খারাপ হলে দায় জেলা সভাপতির।

শুধু বাড়ির মাথাতেই নয়, মেদিনীপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায় উড়ছে অসংখ্য গেরুয়া ঝান্ডা।

আরও পড়ুন: কিছুই বদলায়নি মন্দসৌরে, ঋণের বোঝা নিয়ে মাত্র ২ টাকায় পেঁয়াজ বেচতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক​

অন্যদিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাজ্য জুড়ে প্রচারে ব্যস্ত। মানসবাবুর মতো সময় দিতে পারছেন না প্রচারে। তবে তারই ফাঁকে প্রচারে রাজনৈতিক কথাবার্তার পাশাপাশি তিনি বলছেন,‘‘মানসবাবু তো এখনই সাংসদ। আমি জিতলে এক এলাকা থেকে দু’জন সাংসদ। লাভ তো সাধারণ মানুষের।” তারপরেই তাঁর সঙ্গীরা বলছেন,‘‘দিলীপ ঘোষ কেস খেয়ে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেয়নি বাঁচতে।” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। ২০১৫ সাল সবংয়ে কলেজ ছাত্র কৃষ্ণপদ জানা খুনের ঘটনায় জড়ায় কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইঞার নাম। ওই ঘটনার কিছু দিন পরেই তিনি যোগ দেন তৃণমূলে। সবংয়ে তাঁর ছেড়ে যাওয়া বিধানসভা আসনে নিজের স্ত্রীকে জিতিয়ে আনেন। জেলা তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই বলেন, সে সময় স্ত্রীকে জেতানোর জন্য পশ্চিম মেদিনীপুর নয়, পাশের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের তৃণমূল নেতা নান্টু প্রধানের শরণাপন্ন হয়েছিলেন মানস।

শালবনিতে প্রস্তাবিত জিন্দলদের ইস্পাত কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট।

বিজেপির জেলা সম্পাদক সৌমেন তিওয়ারির দাবি, ‘‘মানসবাবুকে ওর দলের লোকই ভোট দেবেন না। এ রকম দল বদলানো মানুষকে কেউ বিশ্বাস করে না।”

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলেই এবার দুলছে সাংসদ মানসের ভাগ্য।

ছবি: প্রতিবেদক।

Lok Sabha Election 2019 Mamata Banerjee Trinamool Narendra Modi BJP West Bengal Keshiary
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy