Advertisement
E-Paper

দিলীপ-মানসে জমে উঠেছে মেদিনীপুর

রেল শহর খড়্গপুরের তেলুগু ভোটকে গুরুত্ব দেয় সব দলই। সেই সম্প্রদায়ের জগদীশ রাওয়ের গলায় হতাশা— তেলুগুর সংখ্যা কমছে খড়্গপুরে। রেলে নতুন চাকরি হচ্ছে না। অবসর নিয়ে অনেকে অন্ধ্রে ফিরে যাচ্ছেন।

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০৫:৫৫

ঠান্ডা গাড়ির ভিতরে বসে হাসতে হাসতে শ্রীনু বলেছিলেন, ‘‘দাদা, অ্যায়সা দিন আয়েগা, যব ইঁহাকা এক ভি পাত্তা মেরে ইশারেকে বিনা নেহি হিলেগা।’’

এখন ভোটের মুখে দুপুরে গা-জ্বালানো গরম হাওয়া। সেই হাওয়াতেই মিলিয়ে গিয়েছেন শ্রীনু নায়ডু। বছর দু’য়েক আগে গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে গিয়েছে ৩২ বছরের ডনের শরীর। তখন থেকেই খড়্গপুরের মাফিয়া-রাজে ইতি।
শ্রীনুর স্ত্রী, তেলুগু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিনিধি, পূজা এখন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর।

রেল শহর খড়্গপুরের তেলুগু ভোটকে গুরুত্ব দেয় সব দলই। সেই সম্প্রদায়ের জগদীশ রাওয়ের গলায় হতাশা— তেলুগুর সংখ্যা কমছে খড়্গপুরে। রেলে নতুন চাকরি হচ্ছে না। অবসর নিয়ে অনেকে অন্ধ্রে ফিরে যাচ্ছেন। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও অনেকে পড়াশোনার জন্য অন্ধ্রমুখী। চাচা জ্ঞানসিং সোহনপাল যখন ছিলেন, তখন তাঁকে ভালবেসে তেলুগুরা ভোট দিতেন কংগ্রেসকে। কংগ্রেস এখন দুর্বল। সেই ভোট আজ বিজেপি-তৃণমূলে দ্বিধাবিভক্ত।

খড়্গপুরের এই চিত্রটাই গোটা মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কেশিয়াড়ি, দাঁতন, এগরা, নারায়ণগড়, খড়্গপুর গ্রামীণ, খড়্গপুর সদর, মেদিনীপুর— সর্বত্রই মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। কেশিয়াড়ির একাংশ তৃণমূলের উপরে অসন্তুষ্ট। দাঁতনে তৃণমূলের মানস ভুঁইয়া অনেক বেশি পরিচিত। সবং তথা মেদিনীপুরের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে এই চিকিৎসকের নাম।

মানসবাবু ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। রাতে দেখা করার সময়ে মুখে-চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। গত বার লোকসভা ভোটে ঘাটালে তৃণমূলের দেবের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাহুল গাঁধী আমাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।’’ তৃতীয় হয়েছিলেন সে বার। অভিমান করে ঘনিষ্ঠদের বলছেন, কংগ্রেস অপমান করে বার করে দিয়েছে। মর্যাদা দিয়ে ডেকে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন। বিধানসভায় জিতিয়ে এনেছেন মানসের স্ত্রীকে। এ বার মানসের লক্ষ্য লোকসভা।

প্রচার শুরুর আগে ট্র্যাক-স্যুট পরা বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ হাল্কা মেজাজে বলেন, ‘‘আরে উনি তো রাজ্যসভার সাংসদ রয়েইছেন। আমি লোকসভায় জিতলে দুই সাংসদ মিলে একসঙ্গে মেদিনীপুরের উন্নতির জন্য না হয় লড়াই করব।’’ কিন্তু মেদিনীপুর তো মানস ভুঁইয়া যথেষ্ট জনপ্রিয়? দিলীপবাবুর জবাব, ‘‘ভুলে যাবেন না খড়্গপুরে আমি চাচাকে হারিয়েছি। আর এ তো ভাতিজা।’’

কেশিয়াড়ির পথে খড়্গপুর লোকালে মিলন দাসের দোকানে নিত্যদিন চায়ের পেয়ালায় বিতর্কের ঝড় উঠছে। মিলন বেশ চিন্তিত, ‘‘গত বার এতটা বিজেপির চর্চা শুনিনি।’’ কেশিয়াড়িতে পা রাখতেই উড়ে আসে অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত সমিতি বিজেপির বোর্ড গঠন করার কথা ছিল। সে বোর্ড আজও হয়নি। স্কুলশিক্ষক অচিন্ত্য হাটুই উদ্বিগ্ন, ‘‘অনেক জরুরি কাজ থমকে রয়েছে।’’ প্রথম বারের ভোটার মনমোহন টুডু বলেন, ‘‘খোঁজ নিন। তৃণমূলের নিজেদের মধ্যেই গন্ডগোল রয়েছে।’’

পৃথ্বীরাজ মাইতি মুম্বইয়ে রেল ক্যান্টিনের কাজ ছেড়ে মাস ছয়েক আগে দাঁতনে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন। দাওয়ায় বসে বলেন, ‘‘গ্রামে তৃণমূল কাজ করেছে। মানুষ ১০০ দিনের কাজ পাচ্ছে। কন্যাশ্রীর টাকা পেয়েছে অনেকে। রাস্তাঘাট হয়েছে।’’ এগরার পানিপারুলের মাস্টারমশাই তরুণ মাইতির দাবি,
ধান, বাদাম চাষিরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। গ্রামে পানীয় জল এসেছে। বাসস্ট্যান্ড হয়েছে। স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উন্নতি হয়েছে।

আবার মদনগোপাল মাইতি, শঙ্কর প্রসাদের মতো বাসচালকেরা সন্দিহান। বাস নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে বেড়ানোর ফাঁকে তাঁদের ধারণা, বিজেপির চর্চা বাড়ছে।

নিজের নাম বলতে চাননি নারায়ণগড়ের সেই স্কুল শিক্ষক, গত পঞ্চায়েত ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ডিউটি করতে গিয়ে যাঁর অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হয়নি। ধোঁয়া-ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘‘এক ঘণ্টার মধ্যে ভোট শেষ! তার পরে জনা বারো ছেলে বুথে ঢুকে ক্রমাগত ছাপ্পা দিয়ে চলে গেল!’’

গত বার এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তৃণমূলের সন্ধ্যা রায়। তার পরে পাঁচ বছরে তাঁকে এলাকায় বিশেষ দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে এ বার ভূমিপুত্র মানসকে প্রার্থী করেছেন মমতা। ফলে, সে অর্থে সদ্য কংগ্রেস ছাড়া মানসবাবুকে জিতিয়ে আনার একটা দায় যেন কোথায় রয়ে গিয়েছে দলের ছোট-মাঝারি-বড় নেতাদের।

আরও দুই প্রার্থী রয়েছেন লড়াইয়ে। এক, কংগ্রেসের শম্ভু চট্টোপাধ্যায়। অন্য জন সিপিআইয়ের বিপ্লব ভট্ট। সিপিআইয়ের প্রবোধ পন্ডা ছিলেন মেদিনীপুরের দীর্ঘদিনের সাংসদ। গত বারে প্রবল তৃণমূল ঝড়ে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬৬৫ ভোটে তিনি হেরে যান। ২০১৮-র ফেব্রুয়ারিতে মারা যান প্রবোধ। তাঁর উত্তরসূরি বিপ্লববাবুর চেহারার মধ্যে সিপিএমের জেলা নেতা-সুলভ ঔদ্ধত্য নেই। পারিবারিক কারণে দ্বাদশ শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষ কিন্তু চাইছেন, আমরা আরও বেশি সক্রিয় হই।’’

মেদিনীপুর শহরে কংগ্রেসি রাজনীতির মধ্যেই এত দিন সীমাবদ্ধ ছিল শম্ভুবাবুর জীবন। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। তাঁর কথায়, ‘‘রাহুল-প্রিয়ঙ্কার যৌথ নেতৃত্বের প্রতি যুবা ভোটারদের আস্থা দেখতে পাচ্ছি। তাঁদের অনেকেই ভোট দিতে চান। কিন্তু গ্রামের মানুষের প্রশ্ন, ভোট দিতে পারব তো!’’

পড়ন্ত বিকেলে শহরের উপান্তে শালবনীর কাছে একটি গ্রামের জটলার মধ্যে থেকে এক গৃহবধূর আপ্তবাক্য উড়ে আসে, ‘‘সব সমান। পাঁচ বছরে এক বার নেতা-নেত্রীরা আমাদের সামনে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ান। আমরা ভোট দিই। আর বাকি পাঁচ
বছর ধরে সরকারি দফতর, হাসপাতাল, নেতা-নেত্রীদের দফতর, পুলিশ, প্রশাসনের দরজায় আমরা হাত জোড় করে ঘুরে বেড়াই। এটাই আমাদের ভবিতব্য।’’

Lok Sabha Election 2019 লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Dilip Ghosh Midnapur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy