Advertisement
E-Paper

‘ফাঁকা’ মাঠেও ঘাম ঝরাচ্ছে শাসক দল

তৃণমূল থেকে বিতাড়িত হয়ে বিজেপির বর্তমান প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ চেষ্টা করছেন পুরনো দলের বিভীষণ খুঁজতে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০৬:০২

পড়ন্ত বিকেলে কলেজ রোডের ফাঁকা মাঠে একা ফুটবল নিয়ে কসরত করছিলেন স্থানীয় খেলোয়াড়। কখনও বল ড্রিবল করছেন। কখনও বলে লাথি মেরে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
প্রতিপক্ষ বলে সামনে কেউ নেই। তবে ভাবখানা এমনই যেন প্রতিপক্ষ সামনে। তাই অনুশীলনে কোনও ঘাটতি রাখা চলবে না।

বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর পোড়ামাটির শিল্পের শহর। সেখানকারই কলেজ রোডের সামনে ওই খেলার মাঠের দৃশ্যের সঙ্গে বেশ মিল বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের। কেন্দ্র ঘুরতে এসে বোঝা গেল, প্রধান বিরোধী প্রার্থী প্রচার পর্বেই ছিটকে গিয়েছেন ময়দান থেকে। অন্য দিকে হাওয়াকে প্রতিপক্ষ ভেবেই ময়দান চষে ফেলছেন শাসক দলের প্রার্থী। খোলা চোখে শাসক দল তৃণমূলের প্রার্থী শ্যামল সাঁতরার সঙ্গে বিজেপির প্রার্থী সৌমিত্র খাঁয়ের মহড়ার পার্থক্য এটাই। তবে শ্যামলবাবুকে আবার রক্ষণভাগও সামলাতে হচ্ছে। পাছে ফাঁকতালে গোল হয়ে যায়।

সেটা কেন?

কেন্দ্রের খবর, তৃণমূল থেকে বিতাড়িত হয়ে বিজেপির বর্তমান প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ চেষ্টা করছেন পুরনো দলের বিভীষণ খুঁজতে। বিষ্ণুপুর কেন্দ্রে তিনি বিদায়ী সাংসদ। পুরনো দলের কোনও কোনও বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তিনি নাকি তলায় তলায় যোগাযোগ রাখছেন। স্ত্রী সুজাতা খাঁকে প্রচারের দায়িত্বে নামিয়ে সৌমিত্র নাকি আড়াল থেকে খেলছেন। ফলে মাঠ ফাঁকা হলেও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে হাল্কা ভাব দেখাতে রাজি নন রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী শ্যামলবাবু। সকাল সাতটা থেকে ওআরএসের বোতল গাড়িতে তুলে রাত দশটা পর্যন্ত বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের বিভিন্ন জায়গায় পাক খাচ্ছেন তিনি। প্রচারে নতুন নতুন চমকও দিচ্ছেন। কখনও তপ্ত দুপুরে কর্মীদের মধ্যে খিচুড়ি বিতরণ করছেন, কখনও গরুর গাড়ি কিংবা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে কেন্দ্রে ঘুরছেন। কখনও গ্রামের রাস্তায় হুডখোলা গাড়িতে চড়ে রোড শো করছেন। প্রচারে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলার পাশাপাশি বিজেপি দল ভাঙানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করছেন।

ঠা ঠা দুপুরে অযোধ্যা গ্রামে রোড শো শুরুর আগে ধরা গেল শ্যামলবাবুকে। বিষ্ণুপুরের দায়িত্বে তো স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার উপরে আপনার প্রধান বিরোধী প্রার্থী তো দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রছাড়া। আপনার সামনে তো ফাঁকা মাঠ?

সামান্য হেসে শ্যামলবাবুর জবাব, ‘‘ফাঁকা মাঠ বলে কিছু হয় না। জয়ের ব্যবধান বাড়াতে হবে। বিরোধী প্রার্থী আগে আমাদের দলেই তো ছিলেন। সাংসদ কোটার টাকা খরচ করতে পারেননি। তাঁর করে যাওয়া দুর্নীতির জবাব মানুষের কাছে গিয়ে আমাদের দিতে হচ্ছে।’’ কিন্তু শোনা যাচ্ছে আপনার দলের কেউ কেউ সৌমিত্রবাবুকে সাহায্য করছেন। শ্যামলবাবুর জবাব, ‘‘ওটা গুজব। মানুষকে বলছি গুজবে কান না দিতে।’’ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দাবি, গ্রামাঞ্চলের মানুষ ‘সবুজসাথী’, ‘কন্যাশ্রী’-সহ একাধিক প্রকল্পের সুফল পেয়েছেন। ফলে বিজেপি শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবে না। বিষ্ণুপুর পুরসভার চেয়ারম্যান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ বারে জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে।’’

তবে কিছু স্থানীয় সমস্যা কিংবা শাসক দলের ভিতরের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কথাও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইন্দাস কিংবা বিষ্ণুপুরে কোনও কোনও নেতার গায়ে না কি ‘বাইরে শ্যামল, ভিতরে কমল’ এমন তকমা পড়েছে। অভিযোগ, পর্যটনের কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও বিষ্ণুপুর শহর নোংরা হয়ে পড়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে ডুবে থাকে বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চ, শ্যামরাই মন্দির, জোড়বাংলার মন্দিরের মতো দর্শনীয় স্থান। বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ বালুচরী শাড়ির এলাকা কৃষ্ণগঞ্জে তাঁতিদের ক্ষোভ তাঁত বিলির ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ করা হয়েছে।

আবার গ্রামের দিকে এ বার বেশ আলোচনায় রয়েছে অবৈধ বালি খাদানকে ঘিরে দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদের ভাঙনের সমস্যা। অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রশাসনের চোখের উপরেই নদীতে জেসিবি নামিয়ে বালি তোলা হয়। সোনামুখী বিধানসভার রাঙামাটি, নিত্যানন্দপুর কিংবা বিষ্ণুপুর বিধানসভার বনমালীপুর, র‌্যাওড়ার মতো ভাঙন কবলিত গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেআইনি বালি খাদানের টাকায় ভাগ রয়েছে শাসক দলের নেতাদের একাংশেরও। মুখে স্বীকার না করলেও সে সবও চিন্তায় রেখেছে স্থানীয় তৃণমূলকে।

খাদান বিতর্কে নাম জড়িয়েছিল সৌমিত্র খাঁয়েরও। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি বিজেপিতে। দলের নেতাদের দাবি, সৌমিত্র শাসক দলের বিরোধিতা করে বিষ্ণুপুরে বিজেপি-কে অক্সিজেন জুগিয়েছেন।

সৌমিত্রবাবুর স্ত্রী সুজাতার অভিযোগ, সৌমিত্রকে ‘বালি মাফিয়া’, ‘গদ্দার’ বলে দেগে দিয়ে তৃণমূল প্রচার চালাচ্ছে। বিষ্ণুপুর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ঘেরা পিয়ারডোবা স্টেশনে রোড শো করছিলেন সুজাতা। দুপুর রোদে চোখে সানগ্লাস। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মানুষকে একটাই কথা বলছি। সৌমিত্রকে ভয় পেয়েছে তৃণমূল। কলকাতার তৃণমূল নেতারা বালি খাদান থেকে টাকা তুলতে চেয়েছিলেন। সৌমিত্র বাধা দিয়েছে। তাই ওকে ফাঁসানো হয়েছে।’’

আদালতের নির্দেশে বাঁকুড়ায় ঢোকা নিষেধ সৌমিত্রবাবুর। তাঁর দেখা মিলল হুগলির আরামবাগের পারুল মোড়ের কাছে একটি লজে। দুপুরে বিছানায় বসে দই-চিনি খাচ্ছিলেন। সামনে সাজানো তিন-চারটি মোবাইল ফোন। এ বার তো বিষ্ণুপুর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্মান’ রক্ষার লড়াই। তৃণমূল তো জয়ের জন্য ঝাঁপাবেই। আপনি তো কেন্দ্রেই ঢুকতে পারছেন না। তার উপরে আপনার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ।

কথা কেড়ে সৌমিত্রবাবুর জবাব, ‘‘এখানে বালির লরিতে ‘ব্যানার্জি ট্যাক্স’ বসাতে চাওয়া হয়েছিল। পঞ্চায়েতে কেউ ভোট দিতে পারেননি। আমিই বিরোধিতা করেছিলাম। সেটা মানুষ জানে।’’ কেন্দ্রের বাইরে থাকা তাঁর কাছে শাপে বর দাবি করে সৌমিত্রবাবুর দাবি, ‘‘স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। সে আমার প্রচারের সব দায়িত্ব নিয়েছে। আমি নির্বাচনের ছক সাজাচ্ছি। এখানকার তৃণমূলকে আমি চিনি। আমাকে হারাতে হলে কয়েকশো বুথ লুট করতে হবে।’’

বিষ্ণুপুর কেন্দ্রে সোনামুখী এবং বড়জোড়া— দু’টি বিধানসভা রয়েছে সিপিএমের দখলে। দুর্গাপুরের প্রাক্তন সাংসদ তথা এখানে সিপিএমের প্রার্থী সুনীল খাঁর দাবি, ‘‘এ বার সিপিএম-ই জিতবে। অন্য দলের পতাকা যাঁদের বইতে দেখছেন তাঁরা আমাদেরই ভোট দেবেন।’’ তবে বিজেপির মিছিলেই শোনা গেল ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী নারায়ণচন্দ্র খাঁ। তবে কংগ্রেস এখানে তেমন ভাবে লড়াইতে নেই বলেই খবর। বিষ্ণুপুর বিধানসভা সিপিএমের সমর্থনে কংগ্রেস জিতলেও পরে বিধায়ক তুষার ভট্টাচার্য তৃণমূলের দিকেই ঘুরে যান।

Lok Sabha Election 2019 লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Soumitra Khan Bishnupur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy