Advertisement
E-Paper

মঙ্গলকোট থেকে উদ্ধার বিপুল নথি

বর্ধমান বিস্ফোরণ-কাণ্ডে তৃতীয় দিনেই উঠে এসেছিল মঙ্গলকোটের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম। জানা গিয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হতো। দেওয়া হতো জঙ্গি কার্যকলাপের পাঠ। তার পরে কেটে গিয়েছে সাত দিন। রবিবার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র অফিসারেরা গিয়ে দেখলেন, সেখানে পড়ে রয়েছে বহু নথি। ওই প্রতিষ্ঠানে না যাওয়ায় যা চোখেই পড়েনি জেলা পুলিশ বা সিআইডি-র তদন্তকারীদের! বিদ্যুৎবিহীন ওই প্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে রাতে সেখানেই ডেকে নেওয়া হল ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের। সঙ্গে থাকা জেলা পুলিশ আর সিআইডি-র অফিসারেরা সব দেখে থ!

সুনন্দ ঘোষ ও সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১২
শিমুলিয়ায় এনআইএ-র এসপি বিক্রম খালাটে (বাঁ দিকে) ও আইজি সঞ্জীব সিংহ। ছবি: দেবাশিস রায়

শিমুলিয়ায় এনআইএ-র এসপি বিক্রম খালাটে (বাঁ দিকে) ও আইজি সঞ্জীব সিংহ। ছবি: দেবাশিস রায়

বর্ধমান বিস্ফোরণ-কাণ্ডে তৃতীয় দিনেই উঠে এসেছিল মঙ্গলকোটের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম। জানা গিয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হতো। দেওয়া হতো জঙ্গি কার্যকলাপের পাঠ। তার পরে কেটে গিয়েছে সাত দিন। রবিবার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র অফিসারেরা গিয়ে দেখলেন, সেখানে পড়ে রয়েছে বহু নথি। ওই প্রতিষ্ঠানে না যাওয়ায় যা চোখেই পড়েনি জেলা পুলিশ বা সিআইডি-র তদন্তকারীদের! বিদ্যুৎবিহীন ওই প্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে রাতে সেখানেই ডেকে নেওয়া হল ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের। সঙ্গে থাকা জেলা পুলিশ আর সিআইডি-র অফিসারেরা সব দেখে থ!

এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তদন্ত কী ভাবে হওয়া দরকার, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এনআইএ। বর্ধমান-কাণ্ডের তদন্তে নেমে তৃতীয় দিনে প্রায় একই সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে দল পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে তারা। আইজি সঞ্জীব সিংহের নেতৃত্বে যখন একটি দল বর্ধমানে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের তদন্ত করছে, তখনই আর একটি দল ভবানী ভবনে জেরা করছে ধৃত রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবিকে! জেরা করেছে বর্ধমান-কাণ্ডে ধৃত হাসেম মোল্লাকেও।

দুপুরেই একটি দল আবার ঘুরে এসেছে মেটিয়াবুরুজ-সহ কলকাতার বন্দর এলাকার কয়েকটি জায়গা। বন্দর এলাকায় বর্ধমান-কাণ্ডের অন্যতম পান্ডা শাকিল মাঝেমধ্যেই আসত বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল। ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল মেটিয়াবুরুজের লোহাগলিতে একটি বাড়িতে খাগড়াগড়ের মতোই বোমা বিস্ফোরণ হয়। তা নিয়েও এ দিন খোঁজখবর করেছে এনআইএ। তাদের একটি দল গিয়েছিল নদিয়ার থানারপাড়া থানার গমাখালি গ্রামে বর্ধমান-কাণ্ডে অন্যতম সন্দেহভাজন জহিরুল শেখের বাড়িতেও।

মঙ্গলকোটের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যে ভাবে রাতেই কাজ করেছে এনআইএ-র দলটি, তা দেখে সিআইডি-র এক অফিসারের আফশোস, “আমাদের বাহিনীও যদি এমন পেশাদার হতো!”

কেন সিআইডি সুযোগ পেয়েও এত দিনে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নথি সংগ্রহ করতে পারল না, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি এনআইএ-র কেউ। দিল্লি থেকে আসা সংস্থার এক অফিসার বলেন, “এ পর্যন্ত যা তদন্ত হয়েছে, তাতে ভুলচুক হয়েছে কি না, তা দেখার সময় এটা নয়। ময়নাতদন্ত করতে বসলে কাজ এগোবে না। তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে এখন সকলের সহযোগিতা দরকার।” এর পরেই তাঁর সংযোজন, “যদি তদন্ত এগোনোর সময় ধরা পড়ে কোথাও গাফিলতি হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ বর্ধমানের পুলিশ সুপার এস এম এইচ মির্জার অফিসে পৌঁছন এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহ এবং এসপি বিক্রম খালাটে। বেলা দু’টো নাগাদ এসপি অফিসে যান সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপার সব্যসাচীরমন মিশ্র। মিনিট দশেক পরে তিনি বেরিয়ে যান। তার মিনিট পনেরোর মধ্যেই বর্ধমান থানার আইসি আবদুল গফ্ফরকে ডেকে পাঠানো হয় এসপি অফিসে। পুলিশ সূত্রের খবর, এসপি অফিসে একটি অ্যান্টিচেম্বার রয়েছে। সেখানেই এসপি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদারকে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন এনআইএ-র আইজি এবং এসপি। পৌনে ৩টে নাগাদ তাঁরা খাগড়াগড়ের উদ্দেশে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন মির্জাও।

খাগড়াগড়ে পৌঁছে যে বাড়ির দোতলায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে যান এনআইএ কর্তারা। বিস্ফোরণস্থল এবং তার উপরে ছাদ ঘুরে দেখেন। নমুনা সংগ্রহের জন্য আনা একটি বড় স্যুটকেস গাড়িতে রাখা ছিল। মাঝে এক বার অফিসারদের পাঠিয়ে সেটি উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। এত দিন ঘটনাস্থলে সিআইডি বা পুলিশ গেলেই ভিড় জমাতেন এলাকাবাসী। এ দিন এনআইএ-র দল যাওয়ার পরেও ভিড় জমে যায়। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক শেখ ইসলাম বলছিলেন, “আগে যাঁরা তদন্ত করেছেন, তাঁদের থেকে এঁদের হাঁটাচলা, সবই আলাদা। এঁদের দেখেই বোঝা যায়, বড়সড় ব্যাপার!”

বিকেল ৩টে নাগাদ ঘটনাস্থলে ডেকে পাঠানো হয় সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসার পার্থ রায়কে। তার আধ ঘণ্টা পরে এনআইএ-র আইজি এবং এসপি রওনা হন মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ার উদ্দেশে। সঙ্গে ছিল জেলা পুলিশ। শিমুলিয়ায় সেচখাল পেরিয়ে কিছুটা গেলে পুকুরপাড়ে কলবাগান দিয়ে ঘেরা ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে এক সময়ে আলিমা পড়ত। পরে সে এবং রাজিয়া নানা রকম প্রশিক্ষণ দিতে এখানে আসতো বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। খাগড়াগড়-কাণ্ডের অন্যতম চাঁই বলে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেই ইউসুফ এখানকার পরিচালক ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমির মালিক বোরহান শেখ ঘটনার পর থেকেই পলাতক। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশের বাসিন্দা বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের।

বিকেল ৪টে ১০ নাগাদ খড়ের চাল, টিনের দরজা ও মাটির দেওয়ালের ওই প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখেন এনআইএ-কর্তারা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ঘরগুলি থেকে বহু নথিপত্র মিলেছে। কয়েকটি ঘরে বেশ কিছু জেহাদি সংগঠনের কাগজপত্রও পাওয়া গিয়েছে। পড়ুয়াদের খাতায় বেশ কিছু মহিলার নাম মিলেছে, যাদের কারও বাড়ি মঙ্গলকোটে নয়। কেউ বীরভূম, কেউ মুর্শিদাবাদ কেউ আবার নদিয়া বা মালদহের বাসিন্দা। অসমের কয়েক জন মহিলার নামও মিলেছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে তদন্তকারীরা জেনেছেন, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইউসুফ এক সময়ে উত্তরপ্রদেশে থাকত। সেখান থেকে প্রায়ই এখানে লোকজন আসতো।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র থেকে ইউসুফ শেখ ছাড়াও এ দিন ইয়াকুব শেখ, মহম্মদ আরিফ হোসেন, রিয়াজুদ্দিন, আরিফুল ইসলাম, বিন রিয়াজুদ্দিন, বিন জালু মিঞার নাম মিলেছে। এরা অসমের বড়পেটার পানপাড়ার বাসিন্দা। পুলিশ সূত্রের খবর, ইউসুফের ঘর থেকে বেশ কয়েক জনের পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে বই ভর্তি ১৭টি ব্যাগ, ল্যাপটপের চার্জার, ফোন নম্বর লেখা একটি ডায়েরিও। এ ছাড়া আরবি-সহ নানা ভাষার বহু বইপত্র পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি পরীক্ষার জন্য রাত পর্যন্ত সেখানেই থেকে যায় খালাটের নেতৃত্বে একটি দল। রাতে সেখানেই ডেকে পাঠানো হয় ফরেন্সিক ও ভাষাবিদের দলকে। এখানে যে জেহাদের প্রশিক্ষণ হতো, কিছু বইপত্র (যেমন, ‘ভাল মৃত্যুর উপায়’) দেখে সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা প্রায় নিশ্চিত।

এ সব নথি আগে সংগ্রহ করলে তদন্তে আরও অগ্রগতি হতো বলেই মনে করছেন এনআইএ কর্তাদের একাংশ। পুলিশ এবং সিআইডি গোড়া থেকে এই ঘটনাকে যে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি, তা এই সব ঘটনাতেই স্পষ্ট বলে তাঁরা মনে করছেন। বস্তুত, বিস্ফোরণের পর ৪ অক্টোবর এই প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পারে রাজ্য পুলিশ। কিন্তু এ পর্যন্ত সেখানে পা-ই ফেলেনি তারা! পুলিশ সূত্রের খবর, এনআইএ তদন্তভার নেওয়ার পর শনিবার থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের বাইরে পুলিশ পাহারা চালু হয়েছে। এ দিন সেখান থেকেই ওই সব নথি মেলায় রাজ্যের গোয়েন্দাদের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

আজ, সোমবার সকাল থেকে ফের তদন্তে নামবে এনআইএ। মঙ্গলকোটের ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে সব তথ্য মিলবে, সেগুলি খতিয়ে দেখে এনআইএ-র তদন্তকারীরা বীরভূম, মুর্শিদাবাদের নানা জায়গায় হানা দিতে পারেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর।

sunanda ghosh soumen dutta khagragarh blast nia yousuf sekh NIA found huge documents state news online state news burdwan blast case Mangalkot
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy