ফুল, মালা আর মিষ্টির প্যাকেটটা মৃতার ছবির সামনে রেখে চোখের জল মুছতে দেখে বাকিদের মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জেগেছিল। ঘরের দোরে পুলিশি জুতো। কৌতূহলবশত পরিচয় জানতে চেয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলেন এক জন। মাঝবয়সী ওই অপরিচিতের জবাব শুনে তো সকলে থ।
রজনীগন্ধার মালাটা পলিথিনের ঠোঙা থেকে বের করে ছবির ফ্রেমে পরাতে পরাতে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘আমি পুলিশ। ফেসবুকে আলাপ ওর সঙ্গে। হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম করেছি। আমরা দু’জনেই দু’জনকে খুব ভালবাসতাম। ওর বিয়ে হবে মেনে নিতে পারিনি। আপত্তি করেছিলাম। আমাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে বলে দেব বলেছিলাম। কিন্তু তাতে যে ও আত্মহত্যা করতে পারে, ভাবিনি।’’ ঘোলার তীর্থভারতীর বাসিন্দা সুবলচন্দ্র দাস নিজের থেকে বয়সে বড় ব্যক্তির এহেন স্বীকারোক্তিতে প্রথমটায় হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সদ্য উনিশে পড়া মেয়ে পায়েলের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে গত রবিবার বিকালে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার কথা বললেও কারণ কী তা কেউই বুঝতে পারছিলেন না। অপঘাতে মৃত্যু, তাই তিন দিনে মেয়ের পারলৌকিক কাজ করতে বসেছিলেন সবে। পায়েলের মা কাকলিদেবী স্বামীর পাশে বসে নাগাড়ে কেঁদে চলেছিলেন। প্রৌঢ়ের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে কান্না থেমে যায় তাঁর। কিন্তু তত ক্ষণে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। মেঝেতে ফেলে মারধরও শুরু হয়েছে ওই মাঝবয়সীকে। তার মধ্যেই পায়েলের জামাইবাবু অর্ধেন্দু বসু পুলিশে খবর দেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘোলা থানার পুলিশ গিয়ে আশিস চক্রবর্তী নামে বছর পঞ্চাশের ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনায় কিছু ক্ষণের জন্য ঘোলা-মধ্যমগ্রাম রোড অবরোধও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গণপিটুনিতে বিভিন্ন জায়গায় কেটে-ছড়ে যাওয়ায় আশিসবাবুকে প্রথমে পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, জেরায় কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল আশিসবাবু জানিয়েছেন, তিনি ঘোলার ডি ব্লকের বাসিন্দা। বিয়ে করেননি। মায়ের সঙ্গে থাকেন। বছর তিনেক আগে ফেসবুকে পায়েলের সঙ্গে আলাপ। দিন কয়েক ফেসবুকে চ্যাট করার পর ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়। তার পর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত কথা বলা, চ্যাট করা চলত। পায়েলকে বিভিন্ন সময়ে টুকটাক জিনিসপত্রও কিনে দিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল দু’জনের। কিন্তু সম্প্রতি বনগাঁ চাঁদপাড়ায় পায়েলের বিয়ে ঠিক হওয়া এবং পাকা দেখা হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেননি আশিসবাবু। সম্পর্কে তিক্ততা আসতে শুরু করে। দেখা করতে চাইলে বা কথা বলতে গেলে বিভিন্ন অজুহাতে পায়েলের এড়িয়ে যাওয়া মেনে নিতে না পেরেই ঘনিষ্ঠ অবস্থার ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু করেন তিনি। শর্ত একটাই, অন্য কাউকে বিয়ে করা যাবে না।
এ দিকে বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর অসমবয়সী দু’জনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানাজানির ভয়েই পায়েল আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে বলে পুলিশের অনুমান। গত রবিবার বেলা তিনটে নাগাদ শোয়ার ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় পায়েলের দেহ দেখতে পান কাকলিদেবী। ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোটও মেলে। তাতে সরাসরি আশিসবাবুর বিরুদ্ধে কিছু লেখা না থাকায় কেউ জানতেও পারেননি কেন পায়েল আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু বুধবার সকালে আশিসবাবুর উপস্থিতি এবং স্বীকারোক্তি পায়েলের মৃত্যুরহস্য সামনে আনল বলে তদন্তকারীদের দাবি। এ দিন রাতে আশিসবাবুর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় পায়েলের পরিবারের তরফ থেকে। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘তদন্তের আর বাকি রইল কী? পায়ে হেঁটে অপরাধীই যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেল!’’
ডি ব্লকে আশিসবাবুর বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। অনেকেরই বক্তব্য, অনেক কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আশিসবাবুর। বারাসতের একটি স্কুলের শিক্ষিকা থেকে মধ্যমগ্রামের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী, বিভিন্ন জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে মোবাইলে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করারও অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ওই পুলিশকর্মীর মোবাইলটিও পুলিশ আটক করেছে। বহু মহিলার ছবি ও হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক চ্যাট পাওয়া গিয়েছে বলেও তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।