Advertisement
০৭ মে ২০২৪

নেশায় সর্বনাশের জাল ছড়াচ্ছে ‘মেড ইন বিহার’

গন্ধটা সন্দেহজনক। তবে একটু সয়ে গেলেই নেশা ভরপুর! লেবেলে চেনা ব্র্যান্ডের নাম। বোতলের প্যাকেজিংয়ে খাঁটি পেশাদার ছোঁয়া। আসল না নকল ঠাহর করাই ভার।

আনন্দপুর এলাকার গুদাম থেকে উদ্ধার হওয়া জাল মদ। —নিজস্ব চিত্র।

আনন্দপুর এলাকার গুদাম থেকে উদ্ধার হওয়া জাল মদ। —নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

গন্ধটা সন্দেহজনক। তবে একটু সয়ে গেলেই নেশা ভরপুর!

লেবেলে চেনা ব্র্যান্ডের নাম। বোতলের প্যাকেজিংয়ে খাঁটি পেশাদার ছোঁয়া। আসল না নকল ঠাহর করাই ভার। মোটামুটি গেরস্তপোষ্য দামের রাম ও হুইস্কি-র এমনই কিছু জাল সংস্করণ রাজ্যের বাজার দ্রুত ছেয়ে ফেলছে বলে অভিযোগ পুলিশের।

ছোটখাটো মদের দোকান বা মেজ-সেজ পানশালার পেগ! এমনকী পাড়াগাঁয়ে মুদির দোকানের ভাঁড়ারও! পুলিশ ও আবগারি কর্তাদের দাবি, সর্বত্র পাড়ি দিয়েছে এই ‘বিপজ্জনক’ নেশা। বিহারে শিকড়, এমন একটি আন্তঃরাজ্য চক্র এই জাল মদের কারবারের নেপথ্যে বলেও জানতে পেরেছে পুলিশ। গত কয়েক মাসে অভিযান চালিয়ে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে কয়েক লক্ষ লিটার জাল রাম-হুইস্কি উদ্ধার করা হয়েছে বলে তাদের দাবি। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৪০ জনকে ধরাও হয়েছে। কিন্তু তাতেও জাল মদের রমরমা ঠেকানো যাচ্ছে না বলেই আক্ষেপ করছেন অফিসারেরা।

রাজ্যের এক আবগারি-কর্তার কথায়, ‘‘বোতল খোলার পর এই জাল মদের গন্ধটা একটু বেশি ঝাঁঝালো লাগে। আসলের সঙ্গে ফারাক বলতে এটুকুই। তবে আগেই দু-তিন পেগ খেয়ে ফেলেছেন, এমন কারও গেলাসে এই ভেজাল মদ মিশিয়ে দিলে তিনি ধরতে পারবেন কি না সন্দেহ!’’ খুচরো বিক্রেতাদের কাছে এই ভেজাল মদের সব থেকে বড় আকর্ষণ হল— ‘জলের দর’! পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, যে মদের ‘নিপ’ বা ‘কোয়ার্টার’ পাইকারি বাজারে ১২০ টাকায় বিকোয়, খুচরো বিক্রেতা তার জাল সংস্করণ কিনছেন অর্ধেক দামে। ক্রেতাদের হাতে অবশ্য তা আসছে লেবেলে লেখা ওই ব্র্যান্ডের স্বাভাবিক বাজারচলতি দামেই। কিন্তু তাঁরা জানছেন না, স্রেফ মুনাফার লোভে তাঁদের অপরিসীম বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন মদের দোকানদার ও পানশালা মালিকদের একাংশ।

মুনাফাটা যেমন এঁদের, তেমন জাল মদের কারিগরদেরও। একে তো কোনও রকম করের ধাক্কা সামলাতে হয় না। কাঁচামাল বলতে সস্তার বিপজ্জনক সব উপাদান। সেই সঙ্গে হুইস্কি বা রামের আদল আনতে ব্যবহার হয় সস্তার রং। ওই আবগারি-কর্তা বলছেন, এ ভাবে বোতল-পিছু প্রায় ৭০ শতাংশ মুনাফা করছে জাল মদের কারবারিরা।

আবগারি দফতর সূত্রের খবর, উদ্ধার হওয়া জাল মদে মিথানল-সহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রবল উপস্থিতি ধরা পড়েছে। সরকারি রসায়নবিদ শ্যামল চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘নমুনা পরীক্ষা করে বোঝা যাচ্ছে, সস্তার মিথানলের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে ওই মদ তৈরি করা হয়েছে। এই উপাদানগুলোর মাত্রা একটু বেশি হলেই মারাত্মক কাণ্ড ঘটতে পারে।’’ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট দেবাশিস সরকারের কথায়, ‘‘মিথানলের পরিমাণ বেশি হলে লোকে অন্ধ হয়ে যেতে পারে! খুব দ্রুত একের পর এক অঙ্গ কার্যক্ষমতা হারাবে। লিভার-কিডনির দফা রফা হবে। বিষক্রিয়ায় তিন দিনেও কেউ মারা যেতে পারেন।’’

তাতেও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালে এই বিষ-তরলের চলে আসা ঠেকানো যাচ্ছে কই ?

পুলিশ সূত্রের খবর, বিহারের পূর্ণিয়া থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট রুটে এই জাল মদ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। পূর্ণিয়ার বৈশি এলাকা থেকে প্রধানত বর্ধমানের বুদবুদ হয়ে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পাড়ি জমাচ্ছে এই তরল। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘বর্ধমান জেলাকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করছে বিহারের জাল মদের কারবারিরা। বর্ধমান থেকে সড়কপথে উত্তরবঙ্গের মালদহ, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, ডালখোলা, ও উত্তর দিনাজপুরে ওই মদ পাচার করা হচ্ছে।’’ ধৃতদের জেরা করে দক্ষিণবঙ্গেও কয়েকটি ঘাঁটির হদিস পেয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে হুগলির ডানকুনি, হাওড়ার জঙ্গলপুর ও ধুলাগড়, কলকাতার তারাতলাতেও জাল মদের আড়ত গড়ে উঠেছে।

পুলিশকর্তারা বলছেন, কোনও এলাকায় হয়তো মদের দোকান নেই। সেখানে পাড়াগাঁয়ের কিছু মুদির দোকানেই সাধারণ রাম-হুইস্কি বিক্রি হচ্ছে। সেই দোকানগুলোতেও এখন মিলছে এই সব জাল মদ! শহরের কয়েকটি মধ্যবিত্ত পানশালাও নিরাপদ নয়। সম্প্রতি ই এম বাইপাস সংলগ্ন আনন্দপুর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি গুদামে প্রায় হাজার তিনেক ‘মেড ইন বিহার’ মদের বোতল উদ্ধার করেছে পুলিশ।

এমনিতে বিহারের মুঙ্গেরি আগ্নেয়াস্ত্রের জোগান নিয়মিত এ রাজ্যের দুষ্কৃতীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে বলে মানেন পুলিশকর্তারা। সেই অস্ত্র নিয়ে মাঝেমধ্যে নানা গোলমালও ঘটছে। এ বার ‘মেড ইন বিহার’ রাম-হুইস্কির উপদ্রবে নতুন করে মাথায় হাত পড়েছে তাঁদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Made in Bihar liquor drink
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE