Advertisement
E-Paper

‘ভাল’ স্কুল এ বার রাজ্যে নজরকাড়া

ঝাঁ-চকচকে, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলির টানটান প্রতিযোগিতা থেকে বরাবর দূরেই রয়েছে এই স্কুল। ধারাবাহিক ভাবে ভাল ফল করে এলেও, সাজসজ্জায় বা চালচলনে চোখে পড়ার মতো দাগ কাটতে পারেনি এত দিন। কিন্তু শনিবার সকালে মাধ্যমিকের ফল বেরোতেই এই স্কুল প্রমাণ করে দিল, আন্তরিকতা আর অধ্যবসায়ের যুগলবন্দিতে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াতে পারে সাফল্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৭ ০১:১৫
উচ্ছ্বাস: প্রধান শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্যের সঙ্গে মধুমন্তী ও সহপাঠীরা। শনিবার, সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয় ও শিল্প শিক্ষা সদনে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

উচ্ছ্বাস: প্রধান শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্যের সঙ্গে মধুমন্তী ও সহপাঠীরা। শনিবার, সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয় ও শিল্প শিক্ষা সদনে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

এত দিন পরিচিতি ছিল এলাকার ভাল স্কুল হিসেবে। এ বার তা নজর কাড়ল গোটা রাজ্যের।

উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকার সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয় ও শিল্প শিক্ষা সদন থেকে ৬৮২ নম্বর পেয়ে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যের মেধা তালিকায় নবম স্থান দখল করে নিল মধুমন্তী দে।

ঝাঁ-চকচকে, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলির টানটান প্রতিযোগিতা থেকে বরাবর দূরেই রয়েছে এই স্কুল। ধারাবাহিক ভাবে ভাল ফল করে এলেও, সাজসজ্জায় বা চালচলনে চোখে পড়ার মতো দাগ কাটতে পারেনি এত দিন। কিন্তু শনিবার সকালে মাধ্যমিকের ফল বেরোতেই এই স্কুল প্রমাণ করে দিল, আন্তরিকতা আর অধ্যবসায়ের যুগলবন্দিতে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াতে পারে সাফল্য।

বাংলা মাধ্যম, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এই সাদামাঠা স্কুলটি এ দিন তার ছাত্রী মধুমন্তীর সাফল্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে রইল। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর শুভেচ্ছা আর সাক্ষাৎকারের পাহাড় সামলে, দুপুরে যখন স্কুলে পৌঁছল মধুমন্তী, তার চোখে তখন ঘরে ফেরার স্বস্তি। মার্কশিট হাতে নিয়ে পাইকপাড়ার কিশোরী সাফ বলল, ‘‘এই স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়াশোনাকে এতটা ভালবাসতে পারতাম না।’’

চার পাশের এত নামি-দামি স্কুলের পড়ুয়াদের ভিড়ে কখনও নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ হয়নি? মধুমন্তীর উত্তর, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় আমি নিজেও শুনেছি, বড় স্কুলে না পড়লে পিছিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমি আজ যতটুকু এগিয়েছি, তা এই স্কুলের জন্যই। পড়াশোনা ভাল করে শেখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে যেখানেই হোক।’’ স্কুলের আপাত নামডাক দিয়ে নয়, স্কুলের মানুষগুলোর আন্তরিকতা দিয়েই যে এক জন পড়ুয়ার ভবিষ্যতের ভিত তৈরি হয়, তা জোর গলায় জানিয়ে দিল ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাওয়া মধুমন্তী। জানাল, দিনে গড়ে ছ’-সাত ঘণ্টা করে পড়ত সে। পাঠ্যবই এবং শিক্ষিকাদের পড়ানো— অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। ‘‘দীর্ঘ দিনের এই পরিশ্রমের ছাপই আজ মধুমন্তীর মাধ্যমিকের রেজাল্টে প্রতিফলিত হয়েছে।’’— বললেন ১৭ বছর ধরে স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব সামলানো শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য, সকলের প্রিয় বড়দি।

স্কুলের স্টাফরুমের শিক্ষিকাদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার। এত বছরের শিক্ষিকা-জীবনের সাফল্য যেন এক দিনেই তাঁদের এনে দিয়েছে প্রিয় ছাত্রী মধুমন্তী। ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষিকা বিউটি চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই নজর কেড়েছিল মেয়েটি। ক্লাসে যখন যা পড়ানো হতো, একটা শব্দও ওর খাতায় বাদ পড়ত না।’’ বাংলা শিক্ষিকা পারমিতা চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘এত গুছিয়ে উত্তর লিখত ছোট বেলা থেকেই, ওর খাতায় কলম ছোঁয়ানো যেত না।’’ শুধু পড়াশোনা নয়। আবৃত্তি হোক বা তাৎক্ষণিক বক্তৃতা— যে কোনও প্রতিযোগিতায় মধুমন্তীর ডাক পড়ত সবার আগে। ‘‘কোনও প্রতিযোগিতা থেকেই
খালি হাতে ফেরেনি ও।’’— আলমারি ভর্তি উপহার দেখিয়ে গর্ব করে
বললেন শর্মিষ্ঠাদেবী।

স্কুলের ছাত্রীরা জানাল, কী ভাবে নিরলস চেষ্টায় শিক্ষিকারা তাদের শুধু পাঠ্যবই পড়ান, তা-ই নয়, সব দিক থেকে তাদের রীতিমতো ‘গড়ে তোলেন’। সেটা কেমন? এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘যে মূল্যবোধের শিক্ষা সব সময়ে বাড়িতেও দিয়ে ওঠা যায় না, সেটাও আমাদের মেয়েরা স্কুলে এসে পায়। শিক্ষিকারা ওদের মনে এই বোধটা গড়ে তুলতে পেরেছেন যে শুধু ভাল ছাত্রী নয়, ভাল মানুষ হওয়াটাও খুব জরুরি।’’

চলতি বছরে এই স্কুল থেকে ১২৪ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮৮ জন। স্টার পেয়েছে ৪৩ জন ছাত্রী।

শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, এই স্কুলে সমাজের সমস্ত স্তরের মেয়েরা পড়তে আসে। তাই তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে খেয়াল রাখতেই হয়। প্রয়োজনে স্কুলের সময়ের বাইরেও তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়। তাঁরা সব ছাত্রীর পরীক্ষার খাতা খুঁটিয়ে দেখেন। আধ নম্বর কাটা গেলেও, তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। তাঁদের দেখা হয়ে গেলে সব খাতা পৌঁছয় বড়দির কাছে। তিনি ফের খুঁটিয়ে দেখেন খাতা। কোন ছাত্রীর কোন বিষয়ে কতটা অসুবিধা, তা বুঝে শিক্ষিকাদের নির্দেশ দেন সে ভাবে পড়ানোর। প্রয়োজনে বড়দি নিজে ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন বা অভিভাবককে ডেকে পাঠান। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ‘‘স্কুলের ছাত্রীরা আমার সন্তান। আর প্রত্যেক সন্তানের ভাল, খারাপ, দুর্বলতা— সব আমার
নখদর্পণে।’’

কোনও শিক্ষিকাই স্কুলের বাইরে প্রাইভেট টিউশন করেন না বলে দাবি করলেন তাঁরা। ভূগোলের শিক্ষিকা সুপ্রিয়া দে ভৌমিকের কথায়, ‘‘আমরা স্কুলের বাইরে নয়, ভিতরেই অতিরিক্ত সময় দিই। ক্লাস করানো ছাড়াও, প্রত্যেক ছাত্রীর প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করি। খুঁটিয়ে খাতা দেখি।’’ শিক্ষিকাদের কথায়, ‘‘এক জন ছাত্রীকে গড়ে তুলতে গেলে অনেকটা সময় দরকার। প্রাইভেট টিউশনে মন দিলে ওই সময়টা পাব কোথায়?’’

Saraswati Balika Vidhyalaya Madhyamik Examination Madhyamik Madhyamik Result 2017 মাধ্যমিক
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy