এক জন বক্তৃতা করলেন ৬৪ মিনিট। অন্যে ২৩ মিনিট। কিন্তু একই সুরে বাজলেন দু’জন। প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে দেখা গেল মমতা-অভিষেক যুগলবন্দি। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে যা তৃণমূলের জন্য সবচেয়ে বেশি ‘স্বস্তিজনক’।
বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ, ভোটার তালিকা সংশোধন থেকে শুরু করে একাধিক বিষয়ে একই সুর তো শোনা গিয়েছেই দু’জনের কণ্ঠে। একটি দলের সর্ববৃহৎ সমাবেশে সেটা প্রত্যাশিতও বটে। সেটি শাসকদল হলে এবং পরের বছর বিধানসভা ভোটের পরীক্ষা থাকলে তা আরওই কাম্য। কিন্তু মমতা-অভিষেকের পারস্পরিক ‘নৈকট্য’ সোমবার নজর এড়ায়নি তৃণমূলের বড়-মেজো-সেজো এবং ছোট নেতাদের। মঞ্চে দু’জনে পাশাপাশি তো বসেছিলেনই। একাধিক বার দু’জনে দু’জনের দিকে ঝুঁকে আলোচনা সেরে নিয়েছেন সভার অবকাশে। যেমনটা আগে দেখা যেত।
সোমবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ মঞ্চে ওঠেন অভিষেক। তার ২০ মিনিট পরে মঞ্চে আসেন মমতা। মঞ্চে পাশাপাশি চেয়ারে বসেন দু’জন। অভিষেকের পাশে ছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মমতার পাশে ছিলেন মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ (ববি) হাকিম। অভিষেক বক্তৃতা শেষ করে নিজের আসনে গিয়ে বসতেই দেখা যায়, তাঁকে মমতা কিছু একটা বলছেন। অভিষেকও মমতার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে কথা বলতে থাকেন। মমতার হাতে ধরা কাগজের গোছার দিকে দেখিয়েও কিছু বলেন অভিষেককে। যে নথির গুচ্ছ মমতা তাঁর ভাষণের সময় তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন:
মমতার আগে বক্তৃতা করতে উঠে অভিষেক বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ নিয়ে বলেন, ‘‘২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ব্রিগেডের সমাবেশ থেকে আমরা বলেছিলাম, ‘জনগণের গর্জন, বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন’। সেটা শুধু স্লোগান ছিল না। সেটা ছিল বিজেপির চরিত্র উন্মোচন। বাংলায় ভোটে জিততে না-পেরে এ বার বিজেপি বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ শুরু করেছে।’’ তাঁর অব্যবহিত পরে ভাষণ দিতে গিয়ে একই সুরে মমতা বলেন, ‘‘বাংলা ভাষার অপমান মেনে নেব না। দরকারে আবার একটা ভাষা আন্দোলন শুরু হবে।’’ অভিষেক বলেন, ‘‘যে ভাষায় আপনি মা ডেকেছেন, বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন, যে ভাষায় প্রেম হয়েছে, সেই ভাষাতেই কথা বলবেন।’’ মমতা বলেন, ‘‘যে ভাষায় ‘বন্দেমাতরম’ লেখা হয়েছে, যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ লেখা হয়েছে, সেই ভাষার উপর বিজেপি তোমাদের এত রাগ কেন?’’
নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়েও এক সুরে আক্রমণ শানিয়েছেন অভিষেক-মমতা। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ বলেন, ‘‘বিজেপির অস্ত্র এখন দুটো ‘ই’। একটা ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট), অন্যটি ইলেকশন কমিশন (নির্বাচন কমিশন)। নেত্রী যদি নির্দেশ দেন, তা হলে ভোটার তালিকার নাম বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যাব।’’ মমতার যে সেই আন্দোলনে সায় আছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন অভিষেকের পরে বলতে উঠে তিনি জানিয়ে দেন, বিহারের মতো বাংলায় ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশনকে ঘেরাওয়ের মুখে পড়তে হবে।
আরও পড়ুন:
২০২৬-এর ভোটের পরে কী হবে, সে ব্যাপারেও একসুর নেত্রী-সেনাপতি। গত বৃহস্পতিবার দুর্গাপুরে সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতায় তাঁর মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শোনা যায়নি। বদলে তিনি বলেছিলেন ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা দুর্গা’। সেই প্রসঙ্গ টেনে অভিষেক বলেন, ‘‘ঠেলায় পড়ে এখন ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা দুর্গা’ বলতে হচ্ছে! আজ বলে যাচ্ছি, ২০২৬-এর পরে এদের দিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলাব।’’ আর মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা এখন কুৎসা করছেন, বাংলা ভাষার অপমান করছেন, তৃণমূল কর্মীদের চোর বলছেন, তাঁদের গণতান্ত্রিক ভাবে কী করতে হয় সেটাও জানি। আগে বলেছিলাম, বদলা নয় বদল চাই। এ বার বলছি, ওরা জব্দ হবে, স্তব্ধ হবে।’’ দু’জনের বক্তৃতাতেই এসেছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে বিজেপির মিছিল থেকে উত্তর কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ। বাংলাভাষার সম্মানরক্ষার পাশাপাশি সব ভাষা, সব ধর্মের ঐক্যের কথাও শোনা গিয়েছে।
আরও ছিল। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পরে সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতো তৃণমূলও কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে থাকার কথা ঘোষণা করেছিল। তবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পর্বে অভিষেক তাঁর এক্স পোস্টে লিখেছিলেন, পাকিস্তানকে বার্তা দিতে এটাই পাক অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) দখল করার মোক্ষম সময়। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে অভিষেক সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। কিন্তু মমতা তার অবতারণা করেছেন। মোদী সরকারকে নিশানা করে তৃণমূলনেত্রী বলেছেন, ‘‘পিওকে দখল হল না কেন? আপনারা কিসের হিন্দু?’’ গত শনিবার বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ভার্চুয়াল বৈঠকে অভিষেক ভারত-পাক সংঘাত পর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকার কথা তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতের এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, দেশের মানুষকে দেশের খবর জানতে হচ্ছে ট্রাম্পের সমাজমাধ্যমের পোস্ট থেকে। যে কথা মমতা আগে বলেছিলেন। সোমবারও মমতা বলেছেন, ‘‘আপনাদের (কেন্দ্রীয় সরকার) এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।’’
আরও পড়ুন:
ঘটনাচক্রে, এক বছর আগের ২১ জুলাই যে ছবি দেখা গিয়েছিল, তাতে তৃণমূলের অন্দরে খানিক উদ্বেগই তৈরি হয়েছিল। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের কয়েক দিন পর (জুন মাসের মাঝামাঝি) অভিষেক সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করে ‘ছোট বিরতি’তে গিয়েছিলেন। তখন চোখের চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে তখন আলোচনার মূল বিষয় ছিল সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ‘দূরত্ব’। বস্তুত, গত বছর ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের ৭২ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত তৃণমূলে সর্বোচ্চ কৌতূহল এবং আলোচনার বিষয় ছিল, অভিষেক মঞ্চে থাকবেন? শেষ পর্যন্ত সভার আগের দিন কলকাতায় ফিরে সমাবেশে গিয়েছিলেন অভিষেক।
গত বার অভিষেকের ২১ জুলাইয়ের বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে ছিল তৃণমূলে সাংগঠনিক রদবদলের প্রসঙ্গ। আর মমতার বক্তৃতায় ছিল সরকারি প্রকল্পের কথা। তার পরে অগস্ট মাসে আরজি করের ঘটনা এবং তার পরবর্তী সময়ে কয়েকটি টুইট ছাড়া অভিষেকের ‘নীরবতা’ নিয়েও শাসকদলের মধ্যে আলোচনা ছিল। সেই পর্বেই অভিষেকের দফতর সংবাদমাধ্যমকে সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। সেই দায়িত্ব যায় রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর দফতরে। তবে গত কয়েক মাস ধরে আবার ক্যামাক স্ট্রিট থেকেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় রাখা হচ্ছে তৃণমূলের তরফে। এর মধ্যে একাধিক বার অভিষেকের দফতরে গিয়ে বৈঠকও করেছেন প্রবীণ নেতা বক্সী।
‘সুর’ মিলে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিলই। সোমবার ধর্মতলার জনজোয়ার দেখল, সেই ইঙ্গিত ‘বার্তা’ হয়ে আবির্ভূত।