Advertisement
E-Paper

পথে নেমেও বিভ্রান্তি, এ বার ‘বাইরের লোক’

চাপ যত বাড়ছে, ততই যেন দিশাহীন হয়ে পড়ছেন তৃণমূল নেত্রী। আর তাতে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে বাড়ছে বিভ্রান্তি! সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তৎপরতার বিরুদ্ধে পথে নেমে সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এক জন-দু’জন বাইরের লোক কী করল, তা নিয়ে দল ও সরকারকে কলুষিত করা হচ্ছে! চোর বলা হচ্ছে!” যে মন্তব্য শুনে তৃণমূলের অন্দরে গুঞ্জন, সাংসদ কুণাল ঘোষ, সহ সভাপতি রজত মজুমদার, উত্তরপ্রদেশে দলের পর্যবেক্ষক আসিফ খানের পরে এ বার কি সৃঞ্জয় বসুকেও ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি?

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৭
পায়ে পায়ে। সোমবার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে তৃণমূলের উষ্মা-মিছিলে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দেব। ছবি: সুমন বল্লভ

পায়ে পায়ে। সোমবার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে তৃণমূলের উষ্মা-মিছিলে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দেব। ছবি: সুমন বল্লভ

চাপ যত বাড়ছে, ততই যেন দিশাহীন হয়ে পড়ছেন তৃণমূল নেত্রী। আর তাতে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে বাড়ছে বিভ্রান্তি!

সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তৎপরতার বিরুদ্ধে পথে নেমে সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এক জন-দু’জন বাইরের লোক কী করল, তা নিয়ে দল ও সরকারকে কলুষিত করা হচ্ছে! চোর বলা হচ্ছে!” যে মন্তব্য শুনে তৃণমূলের অন্দরে গুঞ্জন, সাংসদ কুণাল ঘোষ, সহ সভাপতি রজত মজুমদার, উত্তরপ্রদেশে দলের পর্যবেক্ষক আসিফ খানের পরে এ বার কি সৃঞ্জয় বসুকেও ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন তিনি?

যদিও দলের একাংশের দাবি, এ বার্তা সৃঞ্জয়ের জন্য নয়। বরং, শুভাপ্রসন্নের মতো ‘অতিথি’দের জন্য! মমতা-ঘনিষ্ঠ এই চিত্রশিল্পীকেও একাধিক বার তলব করেছে সিবিআই। এবং তার পরেই শুভাপ্রসন্নর থেকে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছেন মমতা। এ দিন এক বারের জন্যও শুভাপ্রসন্নর নাম করেননি তিনি।

কিন্তু ঘটনা হল, সারদা কেলেঙ্কারিতে দলের যে নেতারই নাম উঠে এসেছে, তার সঙ্গেই দৃশ্যত দূরত্ব তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তৃণমূল নেত্রী। যেমন, মুকুল রায়ের কর্তৃত্ব অনেকটাই খর্ব করে তুলে এনেছেন ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দল পরিচালনায় মুকুলের একাধিপত্য ছেঁটে দায়িত্ব দিয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সীকে। দূরত্ব তৈরি করেছেন মন্ত্রী মদন মিত্রের সঙ্গেও। তাঁকে এক বার ফোন করে আশ্বাস দিয়েছেন বটে মমতা। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে হাসপাতাল-বন্দি মদনকে দেখতে যাননি তৃণমূলের বড় মাপের নেতাদের এক জনও।

আর সৃঞ্জয়ের দায়ও যে তৃণমূল ঝেড়ে ফেলতে পারে, তার জল্পনা শুরু হয়েছিল ২৪ ঘণ্টা আগে দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য থেকেই। দলের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়ে সৃঞ্জয় প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তিনি ভাল ঘরানার ব্যবসায়ী পরিবারের মানুষ এবং একটি নামকরা সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক। সেই সঙ্গেই ডেরেকের বার্তা ছিল, “কয়েক বছর আগে আমাদের দলে কয়েক জন সাংবাদিককে রাজ্যসভায় টিকিট দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দলে ছিলেন না। এটাকে প্রথা-বহির্ভূত ভাবে দলে অর্ন্তভুক্তি বলা যেতে পারে।” সেই মন্তব্যের সঙ্গে মমতার এ দিনের বক্তব্য মিলিয়ে দেখে দলের অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, তা হলে কি সৃঞ্জয়কেও ত্যাগ করলেন তিনি?

যে সব তৃণমূল নেতা এই ধারণার সঙ্গে এক মত নন, তাঁরা অবশ্য বলছেন, মূলত সৃঞ্জয়ের গ্রেফতারির প্রতিবাদেই নেতাজি ইন্ডোর থেকে এ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তা ছাড়া, সৃঞ্জয় এখনও দলের মুখপত্রের সম্পাদক। ফলে মমতা তাঁকে রাতারাতি ঝেড়ে ফেলতে চাইবেন, এমনটা মনে হয় না। এই নেতাদের বক্তব্য, সৃঞ্জয় নয়, মমতা আসলে কুণাল-শুভাপ্রসন্নদের কথা বলতে চেয়েছেন।

কিন্তু সৃঞ্জয়কে নিয়ে মমতার মন্তব্যে যে বিভ্রান্তি হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। এবং স্বাভাবিক ভাবেই তা উপভোগ করছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ! তাঁর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর ভয়, পাছে সৃঞ্জয়ও কুণালের মতো মুখ খোলেন!” সৃঞ্জয়ের প্রতি তাঁর আহ্বান, “যে দল দু’দিনের মধ্যে আপনাকে ছুড়ে ফেলে, তাকে আপনি বাঁচাবেন কেন? আপনি সব তথ্য সিবিআই-কে দিয়ে দিন!”

শুধু সৃঞ্জয়কে ঘিরে নয়, এ দিন মমতার বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে ছিল বিভ্রান্তির উপকরণ। ঠিক যেমন ছিল শনিবার নেতাজি ইন্ডোরে দলীয় কর্মিসভায়। সেখানে দিশাহারা মুখ্যমন্ত্রী কাকে প্রতিপক্ষ করবেন সেটাই ঠিক করে উঠতে পারেননি। লঙ্ঘন করেছিলেন ভাষার শালীনতাও। ৪৮ ঘণ্টা পরে সোমবার কলকাতার রাজপথে মিছিল এবং ধর্মতলার সভাতে ইন্ডোরের কর্মিসভার মতোই মমতা কখনও আক্রমণ করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি-কে, কখনও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন সংবাদমাধ্যমের দিকে। যদিও দলের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “ইন্ডোরের থেকে এ দিন বিভ্রান্তির মাত্রা কিছুটা কম ছিল!”

কাজের দিন হলেও সোমবার মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলের মিছিল হয়েছে কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত। সেখানে মঞ্চ বাঁধাই ছিল। মিছিল নিয়ে দলনেত্রী আসার আগে সেই মঞ্চ থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মমতা এসেই মাইক নিয়ে এক বার বিজেপি-র মুণ্ডপাত করলেন, তো পর ক্ষণেই দুষলেন সংবাদমাধ্যমকে।

নিজের ছবি বিক্রির প্রসঙ্গ তুলে মমতা বলেন, “একটা ছবি কিনেছে হর্ষ নেওটিয়া। ছবি কিনেছে বলে কেন তাঁকে জেরা করা হবে?” এর পর নিজের চাদর দেখিয়ে বলেন, “আমি একটা চাদর কিনেছি। এখন থেকে সাবধান হতে হবে। কে এটা তৈরি করেছে, দেখতে হবে! না হলেই গ্রেফতার হতে হবে!” ঘটনাচক্রে এ দিনই আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে বিমান বসু মমতার ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “সারদা-কর্তা কত টাকা দিয়ে ওঁর ছবি কিনেছিলেন, ছবি বিক্রি বাবদ উনি কত টাকা আয়কর দিয়েছিলেন, সততার প্রতীক হিসাবে এই প্রশ্নগুলির জবাব দেওয়া উচিত!”

কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণের পরেই প্রতিপক্ষ পাল্টে সংবাদমাধ্যমকে এক হাত নিয়েছেন মমতা। তাঁর সততা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ‘অপপ্রচার’ করছে অভিযোগ তুলে বলেছেন, “জীবনে কারও কাছ থেকে এক পয়সার চা-ও খাইনি। সেই লোকটাকে চোর বলছেন?” তার পরেই আবার কালো টাকা উদ্ধারের দাবিতে সরব হয়ে মোদী সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “আপনারা কালো টাকা নিয়ে আসুন। না হলে আপনাদের কালো চেহারা ফাঁস করে দেব!”

যা শুনে বিজেপির রাজ্য সভাপতির কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ভাষণ তাঁর বর্তমান মানসিক অবস্থার পরিচায়ক! ইউপিএ জমানায় বিজেপি যখন কালো টাকা ফেরানোর দাবি তুলত, তখন তিনি কেন্দ্রে ছিলেন এবং কালো টাকা নিয়ে কোনও কথা বলতেন না। এখন সারদার কালো টাকায় ফেঁসে গিয়ে তাঁর ওই বিষয় মনে পড়েছে!” রাহুলবাবুর পরামর্শ, “কালো টাকা উদ্ধারের বিষয়টা মোদীজিকে ভাবতে দিন। আপনি বরং গরিবের যে টাকা সারদা মারফত তৃণমূলের ঘরে ঢুকেছে, তা ফেরত দিন!” সারদা তদন্তে মুখ্যমন্ত্রীর গোঁসা নিয়ে এ দিন বিমানবাবুও বলেন, “ইউপিএ বা বিজেপি সরকার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়নি। সিবিআই যাতে না হয়, তার জন্য তৃণমূল সরকার ১১ কোটি টাকা খরচ করে মামলা লড়েছিল। তার পরেও সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই দিয়েছে।” বিরোধী পক্ষে থাকার সময়ে মমতা কথায় কথায় সিবিআই তদন্তের দাবি তুলতেন এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিমানবাবু বলেন, “তিনিই এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে পথে নামছেন!”

সৃঞ্জয়ের গ্রেফতারের প্রতিবাদে পথে নামলেও এ দিন তৃণমূল নেত্রীর ৪০ মিনিটের বক্তৃতা নানা বিষয়ের অবতারণায় মূল বিষয়টিই চাপা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যেমন, অনুপ্রবেশ নিয়ে কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করেছেন মমতা এবং পার্থবাবু দু’জনেই। প্রশ্ন তুলেছেন, কেন বিএসএফ ঠিক ভাবে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে না।

“এর সঙ্গে সিবিআইয়ের সম্পর্ক কী!” মমতার বক্তৃতার শেষে প্রশ্ন এক বিভ্রান্ত তৃণমূল কর্মীর।

khagragarh blast bjp saradha scam mamata bandyopadhyay tmc procession agitation in kolkata wrath against Modi paralyse Kolkata tmc protest rally state news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy