অভিবাদন। রেড রোডে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে। শনিবার।
তারকার জৌলুসই হোক বা বিনোদনের রং— স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানের চরিত্রটাই তিনি বদলে দিয়েছেন।
বাম আমলে মহাকরণের সামনে সংক্ষিপ্ত ছিমছাম অনুষ্ঠানের চল ছিল। সেই পরম্পরা ভেঙে গোটা আয়োজনই রেড রোডে সরিয়ে এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এত ঝকমারিতে এ বার জাতীয় পতাকা তোলার আসল কাজটাতেই তালগোল পাকিয়ে গেল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যস্ত রেড রোডের মূল অনুষ্ঠানে। তাঁর বদলে নবান্নে পতাকা উত্তোলন করছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু পতাকার মোটা দড়ি মাঝপথে উঠেই আটকে যায়। শুধু তাই নয়, আঁতকে উঠে তখনই দর্শকেরা দেখেন, ভুল করে তেরঙার গেরুয়া নীচে ও সবুজ উপরে রেখে পুরো পতাকাটাই উল্টো টাঙানো হচ্ছে। এক সরকারি আধিকারিকের বক্তব্য, ‘ভাগ্যিস, পতাকাটা মাঝ পথে আটকে গিয়েছিল, না হলে উল্টো পতাকা পুরোটা উঠে গেলে কেলেঙ্কারি হতো।’ শিক্ষামন্ত্রীও ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়ে যান। গোটা ঘটনার মধ্যে প্রস্তুতির অভাবের ছাপ ছিল বলে তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপ করেছেন। মোটামুটি তিন বারের চেষ্টায় এ দিন নবান্নে জাতীয় পতাকা তোলা সম্ভব হয়।
রেড রোডের মূল অনুষ্ঠানে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পতাকা তুলেছেন। গেরুয়াপাড় কোরা শাড়িতে সাদা ধবধবে হাওয়াই চটি-পরা মুখ্যমন্ত্রীকে এগিয়ে আসতে দেখে দর্শকদের একাংশে রোল উঠল, ‘দিদি তো পুরো ভারতমাতার মতো সেজেছেন।’
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শোভাযাত্রা
ঝাড়গ্রামের মা-মেয়ে অণিমা মাহাতো ও দেবশ্রী মাহাতো এ বার প্রথম এসেছিলেন। পুলিশকে বোঝাতে না-পারায় দর্শকাসনে ঠাঁই পাননি। তাতে অবশ্য দমবার পাত্রী নন তাঁরা। রেড রোডের ধারের ব্যারিকেড ধরে দু’জনে ঠায় দাঁড়িয়ে ঝাড়া দু’ঘণ্টা। কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের ছাত্রেরা কুচকওয়াজ করে যাওয়ার সময়ে তাঁদের চোখ জোড়া গর্বে জ্বলে উঠল। অণিমার পুত্র, দেবশ্রীর ভাই ওই স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্র।
ভাঙড়ের এহসান মোল্লার অবশ্য সব ঘাঁতঘোত চেনা। বছর পাঁচেক ধরে, এ অনুষ্ঠান কখনও ছাড়েন না। ঠিক সময়ে ঢুকে জায়গা দখল করে হাসলেন, ‘দিদিকে ভালবাসি তাই আসি’!
সকালে গোষ্ঠ পাল সরণি তথা কিংসওয়ে দিয়ে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জনতার দিকে হাত নাড়তে নাড়তেই হেঁটে মূল মঞ্চের দিকে এগোলেন। রাস্তার ধারের ছাউনির নীচে বসে অভ্যাগত ও স্থানীয় দর্শকেরা। কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারীদের আত্মীয় পরিজন ছাড়া শাসক দলের তৎপরতায় হাজির কিছু মানুষ! এ ছাড়া বেশির ভাগ সরকারি অনুষ্ঠানে যাদের দেখা যায়, বিনোদন জগতের তেমন কয়েক জন নামজাদা এবং কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী। বিশিষ্টদের ভিআইপি ব্লক পর্যন্ত আধ কিলোমিটার হেঁটে সৌজন্য বিনিময় করতে করতে মুখ্যমন্ত্রী এগোলেন।
অন্য সরকারি অনুষ্ঠানের মতো স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও মমতার জমানায় বিনোদনধর্মী হয়ে উঠেছে। এবং নিছক পুলিশ বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিটুকু ছাপিয়ে এই উপলক্ষটিতে শোভাযাত্রায় মমতার প্রিয় টলিউড, টেলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী তথা খেলোয়াড়েরাও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কয়েক জন প্রবীণ শিল্পীকে গাড়িতে করে রেড রোডে জনতার মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। যাঁরা হাঁটলেন, তাঁদের মধ্যে মমতার ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনীল সেন, রুদ্রনীল ঘোষ, অরিন্দম শীলদেরও হাঁটতে দেখা গিয়েছে।
চলছে গোর্খাদের কুকরি নাচ, দর্শক মুখ্যমন্ত্রী
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে ঠিক মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চের সামনে শুরু হল রংবেরঙের গোষ্ঠীর কুচকাওয়াজ ও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুন্দরবন বালিকা বিদ্যানিকেতনের মেয়েদের নাচের সঙ্গে গান হল, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান!’ পুরুলিয়ার ছৌ থেকে উত্তরবঙ্গের গোর্খাদের কুকরি নাচ— সব-কিছুই ঠাঁই পেয়েছে বিনোদনের তালিকায়।
এর পাশাপাশি, রাজ্য সরকারের কাজের বিজ্ঞাপন হিসেবেও এই মঞ্চটিকে ব্যবহার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার প্রধান আকর্ষণ ছিল, কলকাতা পুলিশের নজরদারির চালকহীন আকাশচারী যান বা ইউএভি (আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকেল)! খোদ মুখ্যমন্ত্রী যার নাম রেখেছেন ‘দুর্দান্ত’। এর বাইরে তাঁর সাধের কন্যাশ্রী বা ক্ষুদ্র শিল্প তথা চরকা কাটা, তাঁতশিল্প, বিবিধ শিল্পসামগ্রীর বিজ্ঞাপনও দেখা গেল।
তবে এ রাজ্যে ভারী শিল্পে লগ্নি টানতে বা কর্মসংস্থান বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রীর চেষ্টার কোনও স্বাক্ষর সরকারি অনুষ্ঠানে ঠাঁই পায়নি। বিধানসভা ভোটের আগে মমতার জমানায় এটাই শেষ স্বাধীনতা দিবস। তাতে রাজ্যের সাফল্যের বিজ্ঞাপনে এটুকুরই যা অভাব থেকে গেল।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy