শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসনের ওপর তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতার চোখ রাঙানি ও গা জোয়ারি নিয়ে প্রথম মেয়াদে অভিযোগ ছিল বিস্তর। বাম জমানার শেষ দিক থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে রোগ ধরেছিল, দেখা গেছিল তৃণমূল জমানায় সেই ক্ষত বেড়েছে বই কমেনি। সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের ভাবমূর্তিই ধাক্কা খেয়েছে তাতে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই সে সবের ওপর কড়া হাতে রাশ টানতে সক্রিয় হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রোমোটিং ও সিন্ডিকেট চক্র বন্ধ করতে শুক্রবার কঠোর বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর চব্বিশ ঘণ্টা না কাটতেই শনিবার দলের নেতাদের ডেকে দিদি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, পুলিশ-প্রশাসনের কাজের ওপর দলের ‘খবরদারি’ বন্ধ করতে হবে। ওদের কাজে ‘নাক গলানো’ কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। একই সঙ্গে দিদির এ ও ফরমান, শিক্ষাঙ্গনেও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। দমন করতে হবে রাজনীতির নামে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে সংঘাত, মারপিট, অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের হেনস্তা করার সংস্কৃতিকে।
সম্প্রতি তৃণমূলের এক কর্মশালায় মমতা ঘোষণা করেছিলেন, দলের সব জেলা সভাপতি, সংগঠনের নেতা ও মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের নিয়ে তিনি দলের নতুন নীতি নির্ধারণ কমিটি গঠন করেছেন। প্রতি মাসের প্রথম শনিবার ওই কমিটির বৈঠক হবে। সেই মোতাবেক এ দিন কালীঘাটে তাঁর বাসভবনে বৈঠক ডেকেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেখানেই দলের উদ্দেশে মূলত তিনটি নির্দেশ দেন মমতা। সূত্রের খবর, নেত্রী জানান পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দিতে হবে। কোথাও কোনও ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে একান্তই যদি কোনও অভিযোগ থাকে তবে সরাসরি জানাতে হবে তাঁকে। তিনি ‘ব্যাপারটা দেখে নেবেন’। কিন্তু তাঁকে না জানিয়ে নিজেরা ‘খবরদারি’ করা চলবে না। একই ভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হিংসা বন্ধ করতে পইপই করে জেলা সভাপতিদের সতর্ক করেন মমতা। দলে গোষ্ঠী কোন্দল বন্ধ করতে এ দিনও ফের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘উপদলীয় কাজ করলে দল থেকে বের করে দেব।’’
তৃণমূল নেত্রীর এই বার্তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। পর্যবেক্ষকদের মতে, তাঁর প্রথম দুই নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে আখেরে তা রাজ্যের ভাবমূর্তি ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা নেবে। বস্তুত পুলিশ ও প্রশাসনের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এ রাজ্যে দীর্ঘদিনের রোগ। বাম জমানার শেষ দিকে তা একেবারে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মজ্জায় ঢুকে যায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাতে কিছুটা রাশ টানার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আলিমুদ্দিনের কাছে তিনিও পেরে ওঠেননি। রাজ্যে পালাবদলের পর সেই রোগেরই ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটে তৃণমূলে। গত পাঁচ বছরে তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এবং সেই কারণেই বার বার প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে রাজ্যে প্রকৃত পরিবর্তন হল কোথায়?
তৃণমূলে মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার মতে, আসলে প্রথম মেয়াদে দলে ঝাঁকুনি দেওয়ার অবস্থায় মমতা ছিলেন না। বরাবর রাজ্যে বিরোধী রাজনীতি করেছেন। এত বড় রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব বুঝে নিতে সময় নিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে এ-ও আশঙ্কা ছিল, রাতারাতি কোনও ঝাঁকুনি দিতে গেলে রাজনৈতিক ভাবে দলের ভবিষ্যৎ না বিপন্ন হয়ে পড়ে! কিন্তু একাই দু’শো পার করার পর দিদির আর সেই আশঙ্কা নেই। বরং তিনিও জানেন, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে দলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফেরাতে সংস্কারের এটাই সুযোগ। বড় বিষয় হল, বাম জমানায় বুদ্ধদেববাবুদের যে টানাপড়েন ছিল সেই সমস্যাও দিদির নেই। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নেওয়ার অধিকার তাঁর একার হাতেই রয়েছে। তাই এ বার শুরু থেকেই কড়া দাওয়াই দিতে শুরু করেছেন তিনি। এক দিকে দলকে সংযত করছেন। অন্য দিকে পুলিশকেও বার্তা দিয়ে বলছেন, উর্দির সম্ভ্রম ফেরাতে হবে। কারণ, মমতা এ ও জানেন এক হাতে তালি বাজছে না। জেলা স্তরে অনেক জায়গায় সিন্ডিকেট, প্রোমোটার, তৃণমূলের নেতা, পুলিশ-প্রশাসন- সব মিলিয়ে একটা চক্র কাজ করছে। সেই চক্রটাকেই ভাঙতে চাইছেন তিনি।
তবে দলের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রীর এই বার্তা নিয়েও তাঁকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধীরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার কাজ করে দেখাতে পারেন, তা হলে তা দশম আশ্চর্য হবে!’’ সিন্ডিকেট বন্ধ করার নির্দেশ প্রসঙ্গে অধীরের তির্যক মন্তব্য, ‘‘সিন্ডিকেট উঠে গেলে তৃণমূলের ভাইরা সব বেকার হয়ে যাবে!’’