বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘হেনস্থা’ এবং তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সামনে আসছে। এই প্রেক্ষিতে বিজেপিকে নিশানা করে এক যোগে সরব হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী দলগুলি। বাংলার বাসিন্দাদের ‘হেনস্থা’র প্রতিবাদে এ বার পথে নামছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজধানী দিল্লি, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের হেনস্থার অভিযোগে আগামী ১৬ জুলাই, বুধবার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিল করবে তৃণমূল। যে মিছিলে হাঁটার কথা তৃণমূল নেত্রী মমতার। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, আগামী বিধানসভা ভোটের আগে ফের বাঙালি-আবেগে শাণ দেবে শাসক দল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দুর্গাপুরে সভা করতে আসার কথা ১৮ তারিখ। তার আগেই নিজে পথে নেমে বিজেপির উপরে চাপ বাড়াতে চাইছেন মমতা।
রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য রবিবার জানিয়েছেন, ১৬ তারিখ বেলা ২টো থেকে দলের সব সাংগঠনিক জেলায় প্রতিবাদ মিছিল হবে। চন্দ্রিমার বক্তব্য, “সচিত্র পরিচয়পত্র দেখানোর পরেও শুধু বাংলায় কথা বলার জন্য হেনস্থা চলছে। দেশের রাজধানীতে জল, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভারতীয় নন? কী চলছে এটা?” বিজেপি অবশ্য ফের অনুপ্রবেশ এবং ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতির কথা বলেই পাল্টা সরব হয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, “মমতা যখনই বিপদে পড়েন, তখনই বাঙালি-বাঙালি মন্ত্র জপ করেন! ভোটে জিততে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের ভারতের নাগরিক বানানোর চেষ্টা করছেন মমতা। চেষ্টা করছেন বাংলার জনবিন্যাসকে বদলে দেওয়ার।”
এই রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেই কোচবিহারে তুফানগঞ্জের ঝাউকুঠির বাসিন্দা আরতি ঘোষের কথা তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বাঙালি বিদ্বেষে’র অভিযোগে প্রচারে নেমেছে তৃণমূল। কোচবিহারের তৃণমূল সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক দাবি করেছেন, তুফানগঞ্জের বাসিন্দা আরতির বিয়ে হয়েছে অসমে। নথি থাকার পরেও অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে তাঁর নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) তালিকা থেকে বাদ দেয় অসম সরকার। বাধ্য হয়ে তিনি কোচবিহারে ফিরে বসবাস করছেন। তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলামও বিষয়টি নিয়ে এক্স হ্যান্ড্লে পোস্ট করেছেন।
আরতির বক্তব্য, ‘‘এটা ২০১৮ সালের বিষয়। আমি পর পর দু’বার এনআরসি-তে আবেদন করি। কিন্তু নাম তোলা হয়নি। প্রয়োজনীয় সমস্ত নথি জমা দিয়েছিলাম।’’ তিনি জানান, বাবা হাইস্কুলে চাকরি করতেন। সে সংক্রান্ত লিখিত তথ্য দিতে তুফানগঞ্জ মহকুমাশাসককে আবেদন করেছিলাম। তাঁরাও সহযোগিতা করেননি। এখন মেয়ে কর্মসূত্রে কোচবিহারে থাকেন, তাঁর সঙ্গেই থাকেন আরতি। তৃণমূল জেলা সভাপতি এ দিন আরতির বাড়িতে গিয়েছিলেন। অভিজিৎ বলেন, ‘‘উত্তম কুমার ব্রজবাসীর ঘটনা সবাই জানেন। আরতি ঘোষ একটা উদাহারণ মাত্র। বিজেপি বাঙালি-বিদ্বেষী, তা বারেবারে স্পষ্ট হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’ যদিও বিজেপির কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক নিখিলরঞ্জন দে বলেছেন, ‘‘দুর্নীতি, ধর্ষণ, খুনে জর্জরিত রাজ্য। মানুষ শুধু অপেক্ষায় রয়েছে। এই সময়ে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে তৃণমূল!’’
বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন দলই এখন বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘হেনস্থা’র প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলেছেন, সমস্যায় পড়লে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রয়োজনে আইনি সহায়তার জন্য জেলায় জেলায় দলের তরফে প্রস্তুতি চলছে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরীরও বক্তব্য, ‘‘কোভিডের সময় থেকেই বলে আসছি, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে রাজ্যে আলাদা দফতর দরকার। যেখানে যেখানে সমস্যা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর তরফে সেখানে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে দ্রুত আলোচনা দরকার।’’ মুর্শিদাবাদ জেলায় তাঁরা এই নিয়ে আন্দোলনে নামবেন বলেও জানিয়েছেন অধীর।
সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন এ দিন থেকেই রাজ্য জুড়ে সপ্তাহভর প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেছে। তারা ১৬ তারিখেই ওড়িশা ভবনের সামনে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন এবং এর পক্ষে রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব আনা, অন্য রাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দফতর খোলার দাবিও তুলেছে লিবারেশন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)