Advertisement
E-Paper

দায়িত্বে কোপ, সংসদের ক্রিজেও কোণঠাসা মুকুল

ডানা ছাঁটা হয়েছে আগেই। এ বার সম্ভবত নখও উপড়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু হল! তৃণমূলে মুকুল রায়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সুব্রত বক্সীর সঙ্গে ভাগ করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু কাগজে-কলমে মুকুলই এখন দলের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। রাজ্যসভার নেতাও। ক’দিন আগেই দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মুকুল দলের সংসদীয় পদেই শুধু আছেন।

অগ্নি রায় ও অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩১
সংসদের বাইরে মুকুল রায়। সোমবার রাজেশ কুমারের তোলা ছবি।

সংসদের বাইরে মুকুল রায়। সোমবার রাজেশ কুমারের তোলা ছবি।

ডানা ছাঁটা হয়েছে আগেই। এ বার সম্ভবত নখও উপড়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু হল!

তৃণমূলে মুকুল রায়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সুব্রত বক্সীর সঙ্গে ভাগ করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু কাগজে-কলমে মুকুলই এখন দলের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। রাজ্যসভার নেতাও। ক’দিন আগেই দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মুকুল দলের সংসদীয় পদেই শুধু আছেন। গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বার সেই তকমাটুকুও ছেঁটে ফেলে তাঁর এক সময়ের বিশ্বস্ত সেনাপতি মুকুলকে সংসদীয় দলের পদ থেকে সরানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন তৃণমূল নেত্রী।

দলের মধ্যে প্রবল চাপে পড়লেও এখনও পর্যন্ত চরম কোনও পদক্ষেপ থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন মুকুল। এমন কিছু বলেননি বা করেননি, যাতে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নিতে পারে দল। বরং, ক্রিকেটভক্ত মুকুল বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিদ্রোহের ঝোড়ো ইনিংস খেলে উইকেট হারানোর চেয়ে ক্রিজ আঁকড়ে থাকতেই পছন্দ করছেন! মুকুলের ঠান্ডা মাথার মোকাবিলায় ঈষৎ চাপে পড়েই তৃণমূল নেতৃত্ব এখন চাইছেন এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ মুকুল নিজে থেকেই দলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পথে চলে যান।

তৃণমূলে আপাতত প্রস্তুতি চলছে, অবিলম্বে সংসদীয় দলের নেতাদের দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস করা হবে। যার মূল উদ্দেশ্যই হল, মুকুলের কাছ থেকে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান পদ কেড়ে নেওয়া। রাজ্যসভারও নেতাও আর সম্ভবত রাখা হবে না তাঁকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রথমে ঠিক হয়েছিল বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে ওই রদবদল হবে। কিন্তু এত দিন সময় নিলে ভুল বার্তা যেতে পারে, এই আশঙ্কায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অধিবেশনের প্রথম পর্বেই ওই রদবদল সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাতে মুকুলকে কড়া বার্তা দেওয়া সম্ভব হয়। যদিও মুকুল নিজে থেকে ইস্তফা দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই এখনও পর্যন্ত প্রকাশ করেননি!

দিল্লিতে যখন মুকুলের বিরুদ্ধে আরও কড়া পদক্ষেপের তৎপরতা, কলকাতার ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু আবার উল্টো! মুকুলের বিধায়ক-পুুত্র শুভ্রাংশু রায়ের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা ঠিক করতেই হিমসিম তৃণমূল নেতৃত্ব! শুভ্রাংশু যে দিন টিভি চ্যানেলে মুখ খুলে সরাসরি দলনেত্রীকেই প্রায় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, সে দিন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, দলীয় নির্দেশিকা লঙ্ঘনের দায়ে বীজপুরের তরুণ বিধায়কের বিরুদ্ধে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বৈঠক করে কড়া ব্যবস্থা নেবে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। সেই ৭২ ঘণ্টার সীমা ফুরিয়েছে আজই। কমিটির বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু মুকুল-পুত্রের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এমনকী, কমিটির পরবর্তী বৈঠক কবে হবে, তা নিয়ে দফায় দফায় নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে রাতে দলীয় সূত্রে বলা হয়েছে, পরের আলোচনার দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত নয়! স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, গুরুদণ্ডের হুঁশিয়ারি দিয়েও তা হলে কি মুকুল-পুত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধায় পড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব?

বিধানসভায় আজ পার্থবাবুর ঘরে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস ছিলেন। পরে অরূপ বলেন, “অনেকগুলি অভিযোগ কমিটির কাছে জমা পড়েছে। সবগুলিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” শুভ্রাংশু ছাড়া দলের আর কোনও নেতা বা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ কমিটির কাছে জমা পড়েছে কি না জানতে চাইলে অরূপের জবাব, “দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে প্রকাশ্যে বলব না।” মুকুল নিজেও ওই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য। সংসদের অধিবেশন চলায় তিনি এখন দিল্লিতে। তৃণমূল সূত্রের খবর, কমিটির পরবর্তী বৈঠকে হাজির থাকার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। মুকুল দিল্লিতে ব্যস্ততার কথাই বলেছেন। পরে অবশ্য এই ব্যাপারে তিনি মুখ খোলেননি। শুভ্রাংশুও ফোন ধরেননি।

তৃণমূলের একটি বড় অংশই বলছে, এই মুহূর্তে মুকুলের অবস্থান অনেকটা নির্গুণ ব্রহ্মের মতো! একের পর এক ধাক্কা আসছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনও ভাবান্তর নেই। মুখে হাসি। শুধু সিগারেটটা পুড়ছে বেশি! মমতার স্নেহচ্ছায়া এবং আসবাবপত্র, দু’টোই তাঁর বাড়ি থেকে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সরে গিয়েছে। তবু প্রতিক্রিয়াহীন মুকুল। আজ সংসদে প্রবেশের সময় কেমন আছেন, জানতে চাওয়া হলে একটু থমকে বলেছেন, “আমি ভাল আছি!”

মুকুলের এই আপাত-শান্ত মনোভাবেই আরও বেশি করে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। দলের এক নেতার কথায়, “মুকুলদা যদি গরম গরম বক্তব্য রাখতেন, তা হলে দলের পক্ষে সুবিধাই হতো। কিন্তু পোড়খাওয়া রাজনীতিক মুকুল, ভাঙবেন তবু মচকাবেন না! দল বা দলনেত্রীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে একটি কথা না বলায় দল-বিরোধী বা শৃঙ্খলাভঙ্গ কমিটিও কিছু করতে পারছে না।” ফলে, অন্য ভাবে চাপ তৈরি করতে হচ্ছে। তারই প্রক্রিয়া হচ্ছে একের পর এক দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া। তৃণমূলের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, মুকুলের পরিবর্তে রাজ্যসভার নেতা হতে পারেন ডেরেক। লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এখন অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত। লোকসভার নেতা হিসাবে আজ দলীয় সাংসদদের কাছে তাঁর অনুপস্থিতির বিস্তারিত কারণ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছেন সুদীপবাবু। তাঁর অনুপস্থিতিতে লোকসভার কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব সাময়িক ভাবে দেওয়া হয়েছে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

কিন্তু সমস্যা তাতেও কমছে না। আজ থেকে শুরু হয়েছে সংসদের বাজেট অধিবেশন। যে হেতু মুকুল খাতায়-কলমে তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা, স্বাভাবিক ভাবেই সংসদে দলের মুখ তিনিই। সংসদীয় সচিবালয় থেকে এখনও তাঁর নামেই সমস্ত বার্তা আসছে। অন্য দলের নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে ও সংসদে কক্ষ সমন্বয়ের প্রশ্নে যোগাযোগ করছেন মুকুলের সঙ্গে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তৃণমূলের পক্ষে। ডেরেক ও কল্যাণকে সম্প্রতি মমতা দায়িত্ব দিয়েছিলেন সংসদীয় কাজে সমন্বয় করার। কিন্তু যত ক্ষণ সরকারি ভাবে মুকুল তাঁর পদে আছেন, তত ক্ষণ ওই দুই নেতাও নিষ্কণ্টক হয়ে কাজ করতে পারছেন না।

যেমন, আজই সংসদে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার পরে রাজ্যসভায় প্রথম সারিতে নিজের আসনে গিয়ে বসেন মুকুল। দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন ডেরেক ও সুখেন্দুশেখর রায়। কিন্তু আগাগোড়া মুকুলের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে দেখা যায়নি তাঁদের! রাজ্যসভা ও লোকসভার বাকি সাংসদেরাও সযত্ন পরিহার করেছেন মুকুল-সঙ্গ! অথচ বরাবর সংসদীয় অধিবেশনে মুকলই সব সময় থাকেন তৃণমূলের বাকি নেতাদের মনোযোগের কেন্দ্রে। কিন্তু আজ তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হল অন্যান্য দলের সাংসদদের সঙ্গে আলাপচারিতায়!

মুকুলকে সংসদে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া অবশ্য ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলগুলির কৌশল ঠিক করার বৈঠকে তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ডেরেক। একই সঙ্গে ঠিক হয়েছে, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার উপরে বিতর্কে রাজ্যসভায় বলবেন সুখেন্দুশেখর ও ডেরেক। সব রকম চেষ্টা চলছে মুকুলকে পা ফেলার কোনও জমিই না দেওয়ার! কালই আবার জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে সংসদের প্রবেশপথের সামনে ধর্না আছে তৃণমূলের। সেখানে মুকুল থাকবেন কি না, তা নিয়েও স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি তৃণমূল নেতৃত্ব।

‘এই আছি কিন্তু নেই’ দশারই অবসান ঘটাতে মরিয়া হচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

agni roy anamitra sengupta mukul roy tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy