পুরবোর্ড গঠনের জন্য ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র অভিযোগ নিয়ে শিলিগুড়ি যখন সরগরম, সেই সময়ে ফের শহরে পা রাখতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত নেপালে ত্রাণ পাঠানোর কাজের সূচনা করাই তাঁর প্রধান কর্মসূচি বলে প্রশাসনিক সূত্রের দাবি। তবে উপলক্ষ যা-ই হোক, শিলিগুড়ির বর্তমান পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরের অন্য তাৎপর্য আছে বলে তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যা।
সরকারি সূত্রের খবর, সব ঠিক থাকলে আগামী ৪ মে, সোমবার সকালের বিমানে বাগডোগরা পৌঁছে সোজা নেপাল সীমান্তের পানিট্যাঙ্কি চেক পোস্টে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকে একযোগে ৩০টি ট্রাকে ত্রাণসামগ্রী যাবে নেপালে। মুখ্যমন্ত্রী সবুজ পতাকা নেড়ে সেই গাড়িগুলি রওনা করাবেন। সে দিন শিলিগুড়িতে রাত্রিবাস করে পরের দিন, মঙ্গলবার দুপুরের বিমানে কলকাতায় ফেরার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। এই সফরের জন্যই সব জেলায় দলের বিজয়ী কাউন্সিলরদের নিয়ে নির্ধারিত বৈঠক এক দিন পিছিয়ে দিয়েছেন মমতা।
যে খবর পাওয়ার পরে তৃণমূলের শিলিগুড়ির নেতা-কর্মীরা যতটা উজ্জীবিত, ততটাই যেন উদ্বিগ্ন বাম শিবির! বামেদের তরফে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগেই ‘নির্দল’ প্রার্থীর লিখিত সমর্থন আদায়ের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে। একাধিক বাম কাউন্সিলরের আশঙ্কা, সরকারি কর্মসূচির ফাঁকে শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড গড়ার ব্যাপারে দিশা দেখানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে পারেন তৃণমূলের একাংশ। যাঁরা যে কোনও উপায়ে তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন বোর্ড গড়তে মরিয়া! সেই জন্য কংগ্রেস-নির্দলের পাশাপাশি তৃণমূল তাদেরও কাছে টানার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে জয়ী বাম শরিক আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফে।
সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার বলেন, ‘‘আমরা সব কিছুই নজরে রাখছি। বোর্ড গঠন আমরাই করব।’’ দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ভূমিকম্পের ত্রাণ বিলির তদারকি মুখ্যমন্ত্রী করুন। কিন্তু শিলিগুড়ির জনতা যে রায় দিয়েছে, তার বিপক্ষে যাঁরা যেতে চাইছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই উৎসাহ দেবেন না!’’
তৃণমূল শিবিরের তরফে একাধিক কাউন্সিলর অবশ্য মনে করেন, বামেদের বোর্ড গঠনের দাবি ধোপে টেঁকে না। তাঁদের বক্তব্য, বামেরা একক ভাবে ২৪টি আসন পেলে জনতা বাম বোর্ড গঠনের পক্ষে রায় দিয়েছে বলে মানা যেত। কয়েকটি আসনে কংগ্রেস ও নির্দলের ভোট কাটাকুটি না হলে ফলাফল তৃণমূলের পক্ষেই যেত। সেই জন্য বাম বিরোধী সব শক্তির সমর্থন নিয়ে বোর্ড গঠন করলে তা শিলিগুড়ির মানুষ মেনে নেবেন বলেই তৃণমূলের জেলা কমিটির বড় অংশের দাবি। জেলা তৃণমূলের একাধিক সদস্য জানান, তাঁরা সুযোগ পেলে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশদে জানিয়ে বোর্ড গঠনের ব্যাপারে সরকারি ভাবে আসরে নামার অনুমতি চাইবেন। যদিও তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেব বলেছেন, ‘‘এ সব নিয়ে আপাতত আমি কোনও কিছু বলতে চাই না। শীঘ্রই সব কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’
বামেরাও অবশ্য বোর্ড গড়া নিয়ে তৃণমূলের যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের পাল্টা যুক্তি, ‘‘বামফ্রন্ট শিলিগুড়িতে ২৩টি আসন পেয়েছে। কংগ্রেস এবং বিজেপির যে প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, তাঁরাও তো লড়েছেন তৃণমূল-বিরোধিতাকে সামনে রেখেই! সুতরাং শিলিগুড়ির রায় যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তা নিয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই!’’
বামেদের একটা অংশের বক্তব্য, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতেও পরের বছরই হলদিয়া পুরসভা নির্বাচনে বামেদের কাছে হেরেছিল শাসক তৃণমূল। পূর্ব মেদিনীপুরের মতো খাসতালুকে এই হার মেনে নিতে না পেরে গোড়া থেকেই বামেদের বোর্ড গড়ার ব্যাপারে তৃণমূল নানা ভাবে বাধার সৃষ্টি করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। বোর্ড গঠন হলেও নানা ভাবে তার কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। শেষ পর্যন্ত বাম বোর্ড ভেঙে যায়। এবং পরে কয়েক জন বাম কাউন্সিলরের সমর্থন নিয়ে তৃণমূল বোর্ড গড়ে। বামেদের অভিযোগ, ওই কাউন্সিলরদের নানা ভাবে ভয় দেখিয়ে সমর্থন করতে বাধ্য করেছে তৃণমূল। বামেদের আশঙ্কা, এখন শিলিগুড়িতেও ‘হলদিয়া মডেলে’ পুরবোর্ডের দখল নিতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একটা অংশ।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি সফরের সময় দলের জয়ী ও পরাজিত সব প্রার্থীই অন্তত এক বার তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চান। সেখানে কয়েক জন যেমন তাঁদের হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে চান। আবার বামেরা অশোকবাবুকে সামনে রেখে লড়লেও তৃণমূল সে ভাবে কাউকে না তুলে ধরায় কী সমস্যা হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করতে চান অনেকে।
উপরন্তু, গৌতমবাবুকে প্রথমে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে দলের একাংশ তুলে ধরলেও পরে তাঁকে টিকিট না দেওয়ায় জটিলতা হয়েছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা চান কেউ কেউ। এমনকী, ‘অন্তর্ঘাত’ এবং এনজেপি-লাগোয়া সংযোজিত এলাকায় কয়েক জনের ‘ঔদ্ধত্য ও দাদাগিরি’র জন্য জেতা আসনেও হার হয়েছে বলে কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে বলতে চান। যদিও সরকারি সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দলের কর্মীদের কতটা সময় দিতে পারবেন, তা নিয়ে দলেই সংশয় রয়েছে।
শিলিগুড়িতে তৃণমূল নেত্রী দলের কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলোচনা সেরেই ফিরবেন বলে ধরে নিচ্ছেন দলের রাজ্য নেতৃত্ব। সেই মতো ৬ মে কলকাতার নজরুল মঞ্চে দার্জিলিং বাদে অন্য সব জেলার জয়ী কাউন্সিলরদের বৈঠকে ডাকা হয়েছে। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বিজয়ী সব কাউন্সিলর, জেলা সভাপতি-সহ জেলার নেতৃস্থানীয় সকলকে বৈঠকে ডাকা হয়েছে। মুখ্য বক্তা দলনেত্রী।’’ কলকাতা পুরসভার সদ্যজয়ী কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণ হবে ৫ ও ৬ তারিখ। তবে ৬ তারিখ তৃণমূল নেত্রীর বৈঠকে যেতে হবে বলে প্রথম দিনেই শাসক দলের কাউন্সিলরেরা শপথ নেবেন।