E-Paper

‘স্কুল থেকে খাবারটা নিয়েই চলে যেতাম কারখানায়, যত তাড়াতাড়ি ঢুকতে পারব, তত লাভ’

পরিত্যক্ত ইটভাটার এক দিকে ছাদ ঢালাই করে তৈরি ঘুপচি ঘর। এতটাই নিচু যে, ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালে ছাদে মাথা ঠেকে যায়। ঘর তো নয়, ‘গ্যাস চেম্বার’! একের পর এক যন্ত্রের পাশাপাশি পড়ে রয়েছে লোহার আলমারি।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৩ ০৬:৪৭
বাজি কারখানায় পাওয়া শিশু শ্রমিকদের হাজিরার খাতা।

বাজি কারখানায় পাওয়া শিশু শ্রমিকদের হাজিরার খাতা। —নিজস্ব চিত্র।

যত তাড়াতাড়ি কারখানায় পৌঁছনো যাবে, তত লাভ। সারা দিন কাজের শেষে সেই বাজি অন্য কোথাও পৌঁছে দিলে উপরি পাওনা। তাই কি মোচপোলের ইটভাটায় চলা বাজি কারখানায় ছোটদের পৌঁছে দিয়ে আসতেন পরিবারের বড়রাই? যার নাগাল পেত না পুলিশও? এই সব প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে ওই কারখানায় কাজ করা কয়েক জন মহিলা ও কিশোরের বয়ান থেকে।

পরিত্যক্ত সেই ইটভাটার এক দিকে ছাদ ঢালাই করে তৈরি ঘুপচি ঘর। এতটাই নিচু যে, ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালে ছাদে মাথা ঠেকে যায়। ঘর তো নয়, ‘গ্যাস চেম্বার’! একের পর এক যন্ত্রের পাশাপাশি পড়ে রয়েছে লোহার আলমারি। সেটির লক ভাঙা। খুলতেই চোখে পড়ল, লকারে হাজারো যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক মাপার পাত্রের পাশাপাশি রাখা দু’টি খাতা। একটি পাতলা কাগজের মলাটের, অন্যটি নীল রঙের বাঁধানো। তার উপরে লেখা, ‘লেবার অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার’। অর্থাৎ, শ্রমিকদের হাজিরা খাতা।

তবে কি এই খাতা ধরেই হিসাব রাখা হত বাজি ও বোমার কারবারের? এই খাতার সূত্রেই কি জানা যাবে, বিস্ফোরণে কারা জড়িত? জানা যাবে, ন’জনের মৃত্যুর পিছনে দায়ী শুধুই বাজি, না কি অন্য কিছু? খাতা খুলতেই চোখে পড়ল, এক দিকে লেখা ১৪ জনের নাম। সঙ্গে ফোন নম্বর। পাশেই তারিখ ধরে ধরে লেখা তাঁদের হাজিরার হিসাব। কয়েকটি পাতা ওল্টাতে সামনে এল, আরও ২৪ জনের নাম লেখা। নীল বোর্ডে বাঁধানো খাতাতেও একই ভাবে নাম রয়েছে অন্তত ৩৮ জনের। কিন্তু কারও কাজের তারিখই নিয়মিত নয়। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত কাজ হলেও মাঝের মাসগুলির হিসাব নেই। আবার হাজিরা রয়েছে অগস্ট মাস থেকে। তবে কি মাঝের ওই সময়ে কারখানা বন্ধ ছিল?

খাতায় লেখা নম্বর ধরে ধরে ফোন করে জানা গেল, মোচপোল, কাঠুরিয়া, বেরুনানপুকুরিয়া-সহ ইছাপুর, নীলগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের কয়েক হাজার মানুষ যুক্ত ছিলেন ইটভাটায় চলা বাজি কারখানার সঙ্গে। যাঁরা নিয়মিত হাজিরা দিতেন, তাঁদেরই হিসাব রাখা হত খাতায়। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মহিলা এবং কিশোর। বছর ১৬-র এমনই এক কিশোরের বাড়ি বিস্ফোরণস্থলের কাছে। সে বলে, ‘‘আমরা বন্ধুরা যেতাম। অনেক বাচ্চাই তো কাজে যেত ওখানে। ২৪টা বাজির বাক্স বানাতে পারলে ১০০ টাকা দেওয়া হত। আরও কিছু কাজ করে দিতে পারলে বাড়তি টাকা।’’

ওই কিশোরের বাবা গাড়ি চালান। মা বলেন, ‘‘স্কুল থেকে ছুটি করে এসে ছেলে ওখানে কাজে যেত। কয়েক দিন গিয়েছিল। সম্ভবত সব মিলিয়ে ৬০০ টাকা পেয়েছিল। তার পরে ওর বাবার বকুনিতে কাজ ছেড়ে দেয়।’’ খোঁজ মিলল বছর বারোর আর এক কিশোরেরও। সে স্কুলে যায় শুধুমাত্র মিড-ডে মিলের জন্য। তার কথায়, ‘‘স্কুল থেকে খাবারটা নিয়েই চলে যেতাম কারখানায়। যত তাড়াতাড়ি ঢুকতে পারব, তত লাভ। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলে সব মিলিয়ে দিনে ৩০০ টাকা হয়ে যেত। এর পরে আমার ব্যাগে ভরে সেই বাজি অন্য কোথাও পৌঁছে দিলে আলাদা টাকা। পুলিশ বা কেউই আমাদের ধরে না।’’

খাতায় নাম থাকা রুবিনা বিবি বলেন, ‘‘প্রায় প্রতিটি পরিবারেই আর্থিক অনটন রয়েছে। পরিবারের বড়রাই ছোটদের ভাটায় কাজে দিয়ে আসেন। কারখানার মালিকদের কাছেও এমন শিশুশ্রমিকের চাহিদা বেশি।’’ তিনি জানান, সাধারণ শ্রমিকদের দিনে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা মজুরি দিতে হবে। তিন বেলা খাবারের টাকা অতিরিক্ত। সেই জায়গায় অধিকাংশ শিশুশ্রমিককে একশো বোমার হিসাবে মজুরি দিলেই তারা খুশি! চার-পাঁচ ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০টা বাক্স ভরে ফেলে কচিকাঁচারা।

ভাটায় কাজ করা মফুরা বিবি ও সইদা বিবির দাবি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে সেখানে লোক আসত কাজে। তাঁদের কথায়, ‘‘রাতের অন্ধকারে লরিতে করে ড্রাম ভর্তি তরল আসত। সে সব কাচের ফানেলে মেপে যন্ত্রে দেওয়া হত। ওই যন্ত্রের সঙ্গেই লাগানো থাকত কাগজ। সেই কাগজেই ছোট ছোট মোড়কে বাজি বার হত। আমরা সে সব বাক্সে ভরতাম। তবে ওই সব যন্ত্রপাতি দিয়ে রাতেও কী সব কাজ হত। সে সব আমরা জানি না।’’

কিন্তু এত কিছু পুলিশ জানত না? সইদার স্বামী বললেন, ‘‘লরিতে আসা তরল যখন ফানেলে মেপে যন্ত্রে ঢালা হত, তখন গ্যাসের গন্ধে টেকা যেত না। দিনের পর দিন মানুষ টিকতে পারছে না। আর পুলিশ কিছু জানত না, সেটা কখনও হয়?’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Duttapukur Blast Duttapukur Blast

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy