বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবনের সামনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
দরকারি বইয়ের পিডিএফ ফোনেই মজুত থাকে তাঁর। কখনও বা বইটা সঙ্গে আনতে হয় গাড়িতে। বিকাশ ভবনের ‘স্যর’কে অফিসে নামিয়ে ফাঁকা সময়টুকু পেলেই ঘাড় গুঁজে হাতের স্মার্টফোনটিতে ডুব দেন ‘ড্রাইভার’। বছর পঁয়ত্রিশের রোগাটে যুবক গাড়ি চালান। অ্যাম্বাসাডরের ‘লোন’ সদ্য ঘাড় থেকে নামিয়ে ইদানীং বেশ ফুরফুরে তিনি। বাংলা ভাষার এক ‘যোদ্ধা’, সেই তরুণ! কবি, লেখক, অধ্যাপক— নন তিনি কিচ্ছু। উচ্চ মাধ্যমিক পড়াও শেষ করতে পারেননি। ভাষাসৈনিক এমনও হয়?
ভাষা-দিবসের দিনে এ প্রশ্নে লজ্জা পান, তরুণ সামন্ত। ‘‘ধুর, কী যে বলেন!’’ বাঙালির একুশের উদ্যাপনে কোথাও নেই তিনি। পেশায় ড্রাইভার ছাপোষা গেরস্ত তরুণকে তবু রোজই বাংলা ভাষার অস্ত্রে শান দিতে হয়। বাংলা উইকিপিডিয়ায় নয়-নয় করে বছর চারেকে ৬০০-র বেশি প্রতিবেদন তিনি লিখে ফেলেছেন। না, একটা পয়সাও পান না বিনিময়ে। ফোনের এই ডেটা খরচটুকু নিখাদ ভালবাসার শ্রম। তবে ‘উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন’ তরুণকে ভাল ভাবে কাজ করার জন্য একটি ল্যাপটপ দিয়েছে। আগে বিধানসভা, লোকসভা কেন্দ্র ইত্যাদি রাজনীতির বিষয় নিয়ে খুঁটিনাটি লিখতেন! এর পরে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের জীবনী। এখন উত্তমকুমারের বিভিন্ন ছবি নিয়ে পড়েছেন তরুণ। ‘‘বেশি পড়াশোনা জানি না...লিখতে সময় লাগে। কিন্তু উইকিপিডিয়ায় বাংলা লেখা এত কম। হিন্দি, তামিলেও অনেক বেশি লেখা! ভাবলে, লজ্জা করে!’’
সারা পৃথিবীতে ২৩ কোটি বাংলাভাষী। তামিলভাষী মেরেকেটে সাড়ে ৭ কোটি। কিন্তু উইকিপিডিয়ায় ১,০২,০০০টি বাংলা প্রতিবেদনের পাশে তামিলে প্রতিবেদনের সংখ্যা ১,৩৪,৮৩১টি। উইকিপিডিয়ার প্রতিবেদনের বানান, লেখার মান, সত্যতা— নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু তার উপযোগিতাও অনস্বীকার্য। অনুদান-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের অন্তর্গত বাংলা উইকিপিডিয়ার জনৈক প্রশাসক জয়ন্ত নাথের কথায়, ‘‘স্বেচ্ছাসেবীদের কাজটা নিখরচার। কিন্তু কোনও বিশেষ প্রকল্পের প্রস্তাব খতিয়ে দেখে টাকা মঞ্জুর করা হয়।’’ তবে সম্পাদনার অধিকার গণতান্ত্রিক। রাজনৈতিক বা অন্য কুমতলবে কেউ প্রতিবেদনের লেখা বিকৃত করারও চেষ্টা করে। সেটা সামলানোও প্রশাসকদের মাথাব্যথা।
জয়ন্ত বলছেন, বাংলা উইকিপিডিয়াকে টানছেন বাংলাদেশের প্রতিবেদকেরাই। শতকরা ৮০ ভাগ লেখাই তাঁদের। পশ্চিমবঙ্গের লেখক-সম্পাদকদের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিবেদন (৫০,৬৫৭টি) বনগাঁর খড়ুয়া রাজাপুর গ্রামের চাষির ঘরের ছেলে শুভেন্দু খাঁ-র। বিএসসি পাশ, ২৬ বছরের যুবক এখনও চাকরির পরীক্ষায় লড়ছেন। বাঙালিদের মধ্যে এক নম্বরে বাংলাদেশের ওয়ারাকা সাকি (৮৬,৩০১টি প্রতিবেদন)। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘গ্রামে থাকি বলেই বুঝি। সবাই তো ইংরেজি বোঝেন না! বাংলা লিখে তাই শান্তি হয়!’’
ভারতীয় ভাষার মধ্যে সব থেকে এগিয়ে উর্দু (১,৬০,৮৪২টি প্রতিবেদন)। হিন্দি (১,৪৫,৯৮১টি প্রতিবেদন) ও তামিলের পরেই বাংলা। উইকিতে প্রতিবেদনের সংখ্যায় বাংলা ভাষা ২৩ নম্বরে। আর এক স্বেচ্ছাসেবী রঙ্গন দত্ত বলছিলেন, ‘‘উইকিভয়েজে বেড়ানোর তথ্য, উইকিসোর্সে মেধাস্বত্ত্ব মুক্ত বইয়ের পিডিএফের মতো নানা রকম ভাগ উইকিপিডিয়ায়।’’ জয়ন্তবাবুর কথায়, ‘‘ইউরোপের অনেক ছোট দেশও বোঝে, মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশটা মৌলিক অধিকার। শিক্ষিত বাঙালিরা বাংলায় লিখতে এগিয়ে এলে অনেকে উপকৃত হতেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy