জয়শঙ্কর সাউ।
ফের গুলি চলল রেলশহরে।
ভরদুপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় ব্যবসায়ীকে গুলি চালিয়ে খুন করে চম্পট দিল দুষ্কৃতীরা। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ খড়্গপুরের গোলবাজার এলাকার ঘটনা। মৃতের নাম জয়শঙ্কর সাউ (৪০)। গোলবাজারের জনতা মার্কেটের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী জয়শঙ্করবাবুর বাড়ি খড়্গপুরের খরিদায়। এ দিন ব্যবসায়িক কাজে গোলবাজারে পেঁয়াজের গুদামে (গদি) এসেছিলেন জয়শঙ্করবাবু। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গুদামের অদূরেই দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে মাটিতে লুঠিয়ে পড়েন ওই ব্যবসায়ী। স্থানীয়রা জয়শঙ্করবাবুকে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত জনতা রেলশহরে দুষ্কৃতী তাণ্ডব বন্ধের দাবিতে খড়্গপুর বাসস্ট্যান্ড-গোলবাজার রাস্তা অবরোধ করে। ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার খড়্গপুর বন্ধের ডাক দিয়েছে জেলা ব্যবসায়ী সমিতি। তৃণমূল বাদে বাকি রাজনৈতিক দলগুলি এই বন্ধকে সমর্থনও জানিয়েছে।
রেলশহরে গুলিচালনার ঘটনা অবশ্য এই প্রথম নয়। খড়্গপুরে পুরবোর্ড গঠনের কয়েকদিন আগে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর সুনীতা গুপ্তর স্ত্রী রাজু গুপ্তকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। যদিও গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। খড়্গপুরের আরও দুই কাউন্সিলরের বাড়ির সামনেও গুলিচালনার অভিযোগ ওঠে। গত ১২ জুন শহরের মালঞ্চতে ঝাড়গ্রামের এক ঠিকাদার সমীর পয়ড়্যার কাছে থাকা লক্ষাধিক টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। গত ২৭ মে সুভাষপল্লি এলাকায় বাড়ির সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে গোলবাজারের ব্যবসায়ী প্রবীর চক্রবর্তীর লক্ষাধিক টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মালঞ্চ এলাকাতেই গত ৬ মে ভরদুপুরে গুলি চালিয়ে লক্ষাধিক টাকা ডাকাতি হয়। ওই ঘটনায় জখম হন দু’জন। যদিও এখনও অধিকাংশ ঘটনারই কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
গত মাসেই সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এককাট্টা হয়ে দুষ্কৃতী তাণ্ডব বন্ধের দাবিতে খড়্গপুর বন্ধ ডাকে। তারপরও যে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি, এ দিনের ঘটনায় ফের তার প্রমাণ মিলল। এ দিন ট্রাফিকের বাসিন্দা শেখ রফিক বলেন, “ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ পর আমরা কয়েকজন এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময় মুন্নাদাকে (জয়শঙ্কর) এ ভাবে পড়ে থাকতে দেখে অটো ডেকে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।” তবে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই ওই ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানান।
বছর কয়েক আগেই জয়শঙ্করবাবুর মায়ের মৃত্যু হয়। বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খরিদার বাড়িতে থাকতেন জয়শঙ্করবাবু। এ দিন স্বামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর লক্ষ্মী মুর্মু বলেন, ‘‘আমাদের কোনও শত্রু ছিল না। আর কিছু জানি না।” তবে জয়শঙ্কর সাউকে খুনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ গোলবাজারের ব্যবসায়ীমহলও। গোলবাজারে জয়শঙ্করবাবুর পাশেই আলু-পেঁয়াজ গদির ব্যবসায়ী কালু জৈনের কথায়, “মুন্নাদা ভাল লোক ছিলেন। এত দিন ব্যবসা করছি এমন ঘটনা কখনও দেখিনি।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের সরকারের সময়েই এ সব হচ্ছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় দুষ্কৃতীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে দেখুন আমরা ব্যবসায়ীরা কী ভাবে রয়েছি।”
এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে মৃতের খুড়তুতো ভাই রাজু সাউ বলেন, “আমার দাদাকে গুলি করা হয়েছে। এক মাস ধরে সমস্ত ব্যবসায়ীরা ভয়ে আছে। সকলের থেকে টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দাদাকেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘প্রশাসন শুধু জানে কাকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে হবে। পুলিশ-প্রশাসন সব জেনেও নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে।”
ঘটনার পরেই জনতা মার্কেটের কাছে খড়্গপুর বাসস্ট্যান্ড-গোলবাজার রাস্তা অবরোধ করে স্থানীয়রা। ঘটনাস্থলে পৌঁছন খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত, এসডিপিও সন্তোষ মণ্ডল-সহ পুলিশ আধিকারিকরা। অবরোধকারীরা পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পরে খড়্গপুরের পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার এলাকায় গেলে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ চলে। বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। যদিও সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ওই ব্যবসায়ীকে পরিকল্পনা করেই খুন করা হয়েছে। জয়শঙ্কর সাউ এলাকায় পরিচিত ছিলেন। তাঁর পুরনো কোনও শত্রু ছিল না বলেও দাবি স্থানীয়দের। স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি ১০ লক্ষ টাকা দাবি করে জয়শঙ্করবাবুকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। সেই টাকা দিতে অস্বীকার করেছিলেন ওই ব্যবসায়ী। তারই পরিণামে তাঁকে খুন করা হল কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
ঘটনার পরই এ দিন বৈঠকে বসে ব্যবসায়ী সমিতি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দুষ্কৃতীরা না ধরা পর্যন্ত খড়্গপুরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ পালন করা হবে। জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাজা রায় বলেন, “গত দু’মাস ধরে শহরে দুষ্কৃতীদের দৌড়াত্ম্যে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত। একের পর এক ব্যবসায়ীকে টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে শুনেছি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ আরও সক্রিয় হলে মুন্নার মতো এক জন নিরীহ ব্যবসায়ীকে খুন হতে হত না। ব্যবসায়ী ও শহরের মানুষের স্বার্থে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ডাকছি।” খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “এখনই এই খুনের কারণ বলা যাবে না। এই ঘটনার পিছনে কারা রয়েছে তা
দেখতে হবে।’’
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy