Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কাজ হারিয়ে সোনার কারিগর রাজমিস্ত্রি

বিজ্ঞাপনে ভেসে ওঠে চওড়া হাসি, আত্মবিশ্বাসী সৌরভ বলেন— ‘বাংলার ডিজাইনই বিশ্ব সেরা’। কিন্তু সে হাসি আর লেগে নেই কারিগরদের মুখে। দিল্লি, মুম্বাই, রাজস্থান, পঞ্জাব হরিয়ানা-সহ সারা দেশে সোনার ওপর নিপুণ ‘ডিজাইন’ আঁকেন বাংলার পটু কারিগরেরা।

সোনার কাজে মন্দা, তাই রাজমিস্ত্রির কাজ করেই দিন গুজরান। দাসপুরে কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।

সোনার কাজে মন্দা, তাই রাজমিস্ত্রির কাজ করেই দিন গুজরান। দাসপুরে কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।

অভিজিৎ চক্রবর্তী
ঘাটাল শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

বিজ্ঞাপনে ভেসে ওঠে চওড়া হাসি, আত্মবিশ্বাসী সৌরভ বলেন— ‘বাংলার ডিজাইনই বিশ্ব সেরা’। কিন্তু সে হাসি আর লেগে নেই কারিগরদের মুখে।

দিল্লি, মুম্বাই, রাজস্থান, পঞ্জাব হরিয়ানা-সহ সারা দেশে সোনার ওপর নিপুণ ‘ডিজাইন’ আঁকেন বাংলার পটু কারিগরেরা। এ বার তাঁরা একে একে ফিরে আসছেন নিজের গ্রামে। কেউ করছেন একশো দিনের কাজ, কেউ নিজের মাঠে ফের নেমেছেন চাষের কাজে, কেউ বেচছেন সব্জি। কেউ আবার শুধুই দিন গুনছেন, খুঁজছেন একটা কাজ।

সোনার কাজে সুযোগ কমছে। গত দশ-কুড়ি বছর ধরে সোনার কাজ করেও ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন দাসপুরের জোতঘনশ্যামের বিশ্বজিৎ সাউ, ডেবরার চিরঞ্জিত সামন্ত, দাসপুরের নিশিন্দিপুরের বিমল মাইতি, ঘাটালের অরূপ সামন্ত, গৌরার সৌম্যদীপ জানা, ভুতার কৌশিক বেরারা।

অথচ, এই সোনার কাজের উপর নির্ভর করেই পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, ডেবরা, পিংলা, সবং প্রভৃতি এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। জেলার লক্ষাধিক যুবক ভিন্ রাজ্যে স্বর্ণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। গত পাঁচ-ছ’মাস ধরেই তাঁরা গ্রামে ফিরছেন। এখনও যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের রোজগারও যে ক্রমশ কমছে তাও জানাচ্ছেন এই যুবকরা।

ব্যবসায়ীদের দাবি, নতুন করে উৎপাদন শুল্ক বৃদ্ধি করায় একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে সোনা শিল্পে। দিল্লির করোলবাগের এক সোনার দোকানের মালিকের জানালেন, আগে কেন্দ্রের তেমন নজরদারি ছিল না। ফলে অনেকেই খাতায়-কলমে দু’কিলো সোনা দেখিয়ে ১০ কিলো সোনার কাজের বায়না দিতেন। শিল্পীরা কাজ করতেন। কিন্তু এখন সোনার কাজ করলেই পাকা বিল দেখাতে হবে। ফলে লাভের সুযোগ, কাজের সুযোগ— সবই কমছে। তার উপর রয়েছে সোনার দাম ওঠা নামাও।

করোলবাগের স্বর্ণকারদের পক্ষে গোপীনাথ সামন্ত, কার্তিক ভৌমিকেরা জানান, এখন ব্যবসা বড় মন্দা। অর্ডারও কম আসছে। অনেক কারিগর কাজ পাচ্ছে না। গোপীনাথবাবুর কাছে আগে প্রায় ৮০ জন কারিগর ছিলেন। এখন তা ৩০-এ দাঁড়িয়েছে।

শো-রুম মালিকেরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সোনা দিয়ে গয়নার বরাত দিয়ে যান। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আবার সেই সোনা কারিগরদের দিয়ে কাজ করিয়ে গয়না সরবরাহ করেন। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখনকার নীতি অনুযায়ী— যত টুকু সোনা, তত টুকু কাজ। ফলে যাঁদের কাছে সোনা মজুদ রয়েছে বাজারে তাঁরাই টিকে থাকছেন। ছোট-মাঝারি সোনা ব্যবসায়ীদের কাজ কমে যাচ্ছে।

কার্তিক ভৌমিকের কথায়, “প্রশাসনিক জটিলতা, উৎপাদন শুল্ক— নানা কারণেই সোনা শিল্প সঙ্কটে। সরকার নজর না-দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’’ মুম্বইয়ের বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী কল্যাণ সঙ্ঘের পক্ষে অসিত মাঝি বলেন, “দিল্লির মতো এখানেও একই পরিস্থিতি। আমাদের শিল্পী সঙ্ঘে-সহ অনান্য সংগঠনের প্রায় আট হাজার সদস্য গ্রামে ফিরে গিয়েছেন।’’

ইতিমধ্যেই গ্রামে ফিরেছেন দাসপুরের জোতঘনশ্যামের বিশ্বজিৎ সাউ। তিনি বলেন, “গত কুড়ি বছর ধরে সোনার কাজ করে ভালই রোজগার করেছি। নিজের বাড়িও করেছি। কিন্তু মাস পাঁচেক কোনও কাজ নেই। তাই হায়দরাবাদ থেকে ফিরে এসে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করছি। সংসার চালাতে হবে তো।” দাসপুরের নিশিন্দিপুরের বিমল মাইতি মুম্বইতে সোনার কাজ করতেন। এখন গ্রামে ফিরে সব্জি বিক্রি করেন। ঘাটালের পান্নার সমর পাল মুম্বইয়ের জাভেরি বাজারে দীর্ঘ ১০ বছর সোনার কাজ করতেন। এখন শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।

এত মানুষ কাজ হারিয়ে ফিরে আসায় আশঙ্কায় প্রশাসনও। দাসপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ আশিস হুতাইত বলেন, “প্রতিদিন এত কারিগর গ্রামে ফিরছেন, তাঁদের সবাইকে কাজ দেওয়াও অসম্ভব। কী হবে বুঝতে পারছি না।” দাসপুরের বিধায়ক মমতা ভুঁইয়া বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বেগে। দ্রুত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Goldsmith
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE