Advertisement
E-Paper

মন্দিরে ঢোকার অধিকার চান বাগলারা

বছরে এক বার গ্রামের শীতলা পুজোয় ঢোল বাজান শ্রীমন্ত বাগলা ও আকুল বাগলারা। কিন্তু মন্দিরের ভেতরে ঢোকার অধিকার নেই তাঁদের। পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল ব্লকে আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে একবিংশ শতকে জাতপাতের বেড়াজালে কার্যত একঘরে হয়ে রয়েছে ১০টি ডোম সম্প্রদায়ের পরিবার। কিন্তু ডোম সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম এই কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস, অচ্ছুত করে রাখার এই প্রথার অবসান চান। তাই প্রশাসনের নানা মহলের পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও চিঠি পাঠিয়ে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দাবি করেছেন ওই গ্রামের বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ১৩:১৫
এই সেই শীতলা মন্দির। সাঁকরাইলের আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এই সেই শীতলা মন্দির। সাঁকরাইলের আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বছরে এক বার গ্রামের শীতলা পুজোয় ঢোল বাজান শ্রীমন্ত বাগলা ও আকুল বাগলারা। কিন্তু মন্দিরের ভেতরে ঢোকার অধিকার নেই তাঁদের। পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল ব্লকে আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে একবিংশ শতকে জাতপাতের বেড়াজালে কার্যত একঘরে হয়ে রয়েছে ১০টি ডোম সম্প্রদায়ের পরিবার। কিন্তু ডোম সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম এই কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস, অচ্ছুত করে রাখার এই প্রথার অবসান চান। তাই প্রশাসনের নানা মহলের পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও চিঠি পাঠিয়ে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দাবি করেছেন ওই গ্রামের বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা।

কয়েক বছর আগে এই জেলারই ঘাটালের রামজীবনপুরে পার্বতীনাথের মন্দিরে প্রবেশাধিকার চেয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্থানীয় রুইদাস পল্লির মুচি সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। দীর্ঘ আন্দোলনের পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মন্দিরে ঢোকার অধিকার আদায়ও করে নিয়েছেন তাঁরা। রামজীবনপুরের পথেই এ বার সেই দাবি উঠছে আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে।

আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামে শীতলা মন্দিরটির নাম ‘আঁধারি ভগবতী মন্দির’। কোনও শুভকাজে গ্রামবাসীরা এই মন্দিরে পুজো দেন। মন্দিরে অবশ্য কোনও বিগ্রহ নেই। প্রতিবছর আষাঢ় মাসে ঘটস্থাপন করে বার্ষিক পুজো হয়। সেই পুজোয় যোগদানের কোনও অধিকার নেই বাগলাদের। বাগলা পাড়ার লোক মন্দিরে দেবীর পুজোও দিতে পারেন না। শ্রীমন্তবাবুরা পুজোয় ঢোল বাজানোর জন্য ডাক পান। কিন্তু ডোম ঢোল বাদকদের মন্দিরের দালানে উঠতে দেওয়া হয় না। দূর থেকেই ঢোল বাজাতে হয় তাঁদের।

গ্রামের বাগলা পাড়ার সুবর্ণ বাগলা, ঝুমা বাগলা, মল্লিকা বাগলা, সরস্বতী বাগলারা জানালেন, তাঁদের কারওরই বিশেষ জমিজমা নেই। সাত পুরুষ ধরে বাঁশের ঝুড়ি ও কুলো বানিয়েই দিন গুজরান করেন বাগলারা। গ্রামে ২৮০টি পরিবারের বাস। ব্রাহ্মণ পরিবার মাত্র একটি। তারাই শীতলা পুজোয় পৌরোহিত্য করেন। গ্রামে কায়স্থ, সদ্‌গোপ, বাগদি ও মাঝি সম্প্রদায়ের লোকজনই বেশি। মন্দির কমিটিতেও তাঁদেরই প্রাধান্য।

বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা জানান, শুধু শীতলা মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই তাই নয়, সামগ্রিক ভাবেই অচ্ছুত করে রাখা হয়েছে তাঁদের। পথেঘাটে, দোকান-বাজারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই বাগলাদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন গ্রামবাসীরা। অভিযোগপত্রে এই ডোম সম্প্রদায়ের লোকজনেরা জানিয়েছেন, বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শেখার পরে এই জাতপাত, ছোঁয়াছুয়ির অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে। বাগলা পাড়ার বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে কেন তাঁরা নিজেদের দেবীর মন্দিরে ঢুকতে পারবেন না? কয়েক মাস আগে, মন্দির কমিটির কর্মকর্তাদের কাছে লিখিতভাবে পুজোয় যোগদান করার ও মন্দিরে প্রবেশাধিকার চেয়ে আবেদন করেন বাগলারা। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করে দেয় মন্দির কমিটি। এরপর মাস খানেক আগে বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা নিজেরাই আলাদা করে শীতলা পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। মাস খানেক আগে বাগলা পাড়ার বাসিন্দাদের উদ্যোগে পাড়ায় খড়ের মণ্ডপ গড়ে শীতলা পুজো হয়। তবে ওই পুজোয় স্থানীয় কোনও ব্রাহ্মণ পুজো করতে রাজি না হওয়ায় পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থেকে ব্রাহ্মণ পূজারীকে নিয়ে আসেন বাগলারা। ওই পুজোর পরই গ্রামের মাতব্বরদের বিষ নজরে পড়েছেন বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা। রাত বিরেতে বাগলা পাড়ায় গিয়ে গালিগালাজ করে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন মাতব্বরদের লোকেরা। গ্রামের স্ব-সহায়ক দল থেকে ডোম সম্প্রদায়ের মহিলাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এরপরই সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন বাগলা পাড়ার বাসিন্দারা। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও লিখিত অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের তরফে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “বাগলা পাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ পেয়েছি। আমি নিজে ওই গ্রামে গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।”

এ দিকে, শীতলা মন্দিরে ঢোকার দাবি তোলায় ডোম পরিবারগুলি গাঁয়ের মাতব্বরদের রোষে পড়েছেন বলে অভিযোগ। মন্দির কমিটির সম্পাদক সনাতন প্রধান বলেন, “আমাদের বাবা-ঠাকুরদার আমল থেকে ডোম সম্প্রদায়ের লোকজনের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই। ওরা প্রথা ভাঙতে চাইছেন। কিন্তু গ্রামবাসী তা মানবে কেন! তাছাড়া ওরা তো মাস খানেক আগে আলাদা পুজোও করেছে। তবে এসব নিয়ে গ্রামে কোনও সমস্যা নেই। বাগলা পাড়ার কিছু লোকজন সমস্যা তৈরি করছেন।”

সনাতনবাবু জানান, গ্রামের ওই মন্দিরে বছরে এক বার পুজো হয়। সাধারণত আষাঢ় মাসে বার্ষিক পুজো হয়। এই বছর অবশ্য ১১ বৈশাখে বার্ষিক পুজো হয়ে গিয়েছে। পুজোয় বাগলা পাড়ার যাঁরা ঢোল বাজাতেন তাঁরা এ বার আসেননি। তাই পাশের গ্রাম থেকে এখানে অন্য ঢোলবাদকদের নিয়ে আসা হয়। সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ ভাগবত মান্নার বাড়ি আঁধারি-মৌভাণ্ডার গ্রামেই। ভাগবতবাবুর কথায়, “বর্তমান যুগে জাতপাত কিছু বলে কিছু নেই। এলাকার অন্য দেবদেবীর মন্দিরে বাগলারা তো পুজো দেয়। কেবল গ্রামের এই মন্দিরে সাবেক কিছু নিয়ম চলে আসছে।” তাহলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কেন জাতপাতের বেড়াজাল ভাঙার উদ্যোগ নেননি? ভাগবতবাবুর জবাব “আমাকে ওরা কিছু জানায়নি।” সবশেষে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “এ সব প্রচার করে ওরা কী ঠিক করছে। গ্রামের ২৭০টি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কি ওরা গ্রামে থাকতে পারবে?”

kingshuk gupta bagla community sankrail west medinipur sankrail
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy