জল বাড়ছে নদীতে। ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের মনে।
ক্লান্তিহীন বর্ষায় প্রতিদিনই ফুলেফেঁপে উঠছে শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি, রূপনারায়ণ। জলবন্দি অসহায় দুর্গতেরা দেখছেন, কী ভাবে প্রতিদিন একটু করে গ্রামে বাড়ছে জলস্তর। এ দৃশ্য ঘাটালবাসীর কাছে নতুন নয়। তবু বাড়ছে ক্ষোভ। কারণ, জল তো শুধু ঘাটাল শহর বা তার লাগোয়া এলাকায় বাড়ছে তেমন নয়। মহকুমার বিস্তীর্ণ অংশেরই ছবিটা এক। তবু কোথায় যেন রয়েছে ‘আমরা ওরা’। দিনকয়েক আগেই দাসপুরে রামদেবপুরে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ু জানা নামে এক যুবক তলিয়ে গিয়েছিলেন। দাসপুরের রামদেবপুরের সঞ্জয় জানা বলছিলেন, ‘‘এখানে কয়েকটি গ্রাম জলমগ্ন। ঘর থেকে বেরোনোর সব রাস্তা জলের তলায়। কিন্তু প্রশাসনের কাউকে দেখা যায়নি। যত বন্যা যেন ঘাটাল, চন্দ্রকোনায়।’’ দাসপুরের রাজনগর পশ্চিমের বিনা কালসার বলছিলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে প্রশাসনের লোকেরা এসেছিল। ত্রাণ পেয়েছিলাম। আর কেউ আসেনি। গলা ভর্তি জল পেরিয়ে পানীয় জল আনতে হচ্ছে। গরু-ছাগল গুলোর মুখে খাবার নেই।’’
প্রশাসনের অবশ্য বক্তব্য, সার্বিক পরিস্থিতির উপরেই নজর রাখা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মঙ্গলবার ঘাটাল টাউন হলে ঘাটাল মহকুমার সংশ্লিষ্ট সব দফতরের আধিকারিক, পাঁচ বিডিও, ঘাটালের মহকুমা শাসক-সহ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন জেলা শাসক খুরশিদ আলি কাদেরী। বৈঠকে ছিলেন জেলার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গীও। বৈঠকে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর নেন জেলা শাসক। পরে তিনি বলেন, “ঘাটালের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। প্রশাসনের উদ্যোগে প্রত্যেক পঞ্চায়েত ও পুর এলাকায় রান্না করা খাবার বিলি করা হচ্ছে। কিছু মানুষকে উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে রাখা হয়েছে। নিয়ম করে প্লাবিত এলাকায় স্বাস্থ্য শিবির চলছে।’’ ঘাটালের মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘‘বুধবার জল আরও বাড়তে পারে। এ বার বন্যায় সাপের উপদ্রব একটু বেশি।’’ প্রশাসন সূত্রের খবর, ঘাটাল মহকুমায় মোট ৩১ টি ত্রাণ শিবিরে ৭২৬ জন লোক আছেন। প্রত্যেক শিবিরে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের উদ্যোগে ঘাটাল সহ দাসপুর, চন্দ্রকোনায় কমিউনিটি কিচেন চলছে। এ দিন সন্ধ্যায় ঘাটাল থানায় এসে বন্যা সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার। তিনি বলেন, ‘‘নৌকায় করে পুলিশের বিশেষ টিম বিভিন্ন প্লাবিত এলাকায় পুলিশি নজরদারি চালাচ্ছে। রাতেও চলছে নজরদারি। দুর্গতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’
এ দিনও সব নদ-নদীর জল বিপদ সীমার উপর দিয়েই বইছে। তবে এখনও মাসখানেক আগে মরসুমের প্রথম বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সে বারের বন্যায় ঘাটালের বহু জায়গায় নদীর বাঁধ টপকে এবং বাঁধ ভেঙে জল ঢুকছিল গ্রামে। এ বার সার্বিক ভাবে সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। যদিও আগের বন্যায় চন্দ্রকোনার ভগবন্তপুর ১ ও ২ পঞ্চায়েতের একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙেছিল। তারই একটি অংশ দিয়ে এ দিন চন্দ্রকোনার নদী পারের গ্রামগুলিতে জল ঢুকতে শুরু করেছে। তবে সামগ্রিক ভাবে গতবারের তুলনায় এখনও হাফ ফুটের মত জল কম রয়েছে।
ঘাটালের বন্যায় প্রশাসনের নজর বেশি বলে অভিযোগ উঠলেও ক্ষোভ কম নেই সেখানেও। ঘাটাল শহরের ১২টি ওয়ার্ড পুরোপুরি জলের তলায়। শহরে অধিকাংশ একতলা বাড়ি বন্যার জলে ডুবে গিয়েছে। পুরসভার নিচু এলাকা গুলিতে আবার দোতলা সমান জল। ঘাটাল ব্লকের অজবনগর ১ ও ২, দেওয়ানচক ১ ও ২, মোহনপুর, বীরসিংহ, মনসুকা ১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অবস্থাও খারাপ। বিদ্যুৎ, পানীয় জলের মতো নৌকারও হাহাকার। নৌকার অভাবে প্রশাসনিক কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। কেউ অসুস্থ হলেও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
শিলাবতী নদীর জলস্তর বাড়তে থাকায় নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে গড়বেতা ১ ও গড়বেতা ২ ব্লকের ৮-১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। গত জুন মাসের মাঝামাঝিতে টানা ভারী বৃষ্টির পাশাপাশি জলাধার থেকে জল ছাড়ায় গড়বেতার এই দুটি ব্লকের ১৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় আচমকা বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। হাজার তিনেক মানুষ ঘরদোর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে এসেছিলেন। জুনের আতঙ্ক, জুলাইয়ের মাঝেও দেখা দিয়েছে বেনাচাপড়া, জোগারডাঙা, পিয়াশালা, আগরা, ধাদিকা, শ্যামনগর, সন্ধিপুর, খড়কুশমা প্রভৃতি অঞ্চলে। বহু নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে গিয়েছে। কৃষিজমিও অনেক জলের তলায়। পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে গড়বেতা ১ ও ২ ব্লক প্রশাসন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)