ঝুঁকির অপর নাম আলুর চাষ। লাগলে তুক। না লাগলে তাক। সেই ‘ট্র্যাডিশন’ সমানে চলছে। আর চলছে প্রতিশ্রুতির বন্যা— আলুবীজ উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে বাংলা।
এ বার রাজ্য বাজেটেও শোনা গিয়েছে এই প্রতিশ্রুতি। বলা হয়েছে, আলুবীজের ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে আর পঞ্জাবের উপর নির্ভর করতে হবে না। তবে এই প্রতিশ্রুতি আশার আলো দেখাতে পারছে না আলু চাষের সঙ্গে যুক্ত চাষি, ব্যবসায়ীদের। কারণ, তাঁদের বক্তব্য, এই তো প্রথম নয়। বাম আমলেও একবার এই রাজ্যে সরকারি ভাবে উন্নতমানের আলু বীজ উৎপাদনের কথা উঠেছিল। কিন্তু কোথায় কী! কৃষি দফতর সূত্রের খবর, এই রাজ্যে আলু বীজ লাগে ৬০ লক্ষেরও বেশি প্যাকেট (৫০ কিলোর প্যাকেট)। রাজ্যে আছে ৬-৭ টি বীজখামার। সেখানে গড়ে বীজ উৎপাদন হয় বড় জোড় ১০ লক্ষ প্যাকেট।
গোয়ালতোড়ের দুর্গাবাঁধের মতো যে সরকারি বীজখামার রয়েছে সেখানে টানা দু'বছর আলুবীজ উৎপাদন হচ্ছে না। তবে জেলার একটি ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তা বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় আনন্দপুরের খামারে আলু বীজ উৎপাদন হচ্ছে। বাঁকুড়ার রাইপুরেও হচ্ছে। এখানে নেট হাউস পদ্ধতিতে বীজ হচ্ছে। হুগলির পোলবা-সিঙ্গুরেও সরকারি খামারে আলু বীজ হচ্ছে। আলু বীজ হচ্ছে উত্তরবঙ্গেও। সরকার চেষ্টা করছে আলু বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে। সে দিকেই এগোচ্ছে রাজ্য।’’ তবে চাহিদা ও জোগানের যে ফারাক অনেক বেশি তা অস্বীকার করেন না কেউই। ফলে আলুবীজের জন্য পঞ্জাবের উপর নির্ভরতাই বাস্তবতা। এই রাজ্যের ব্যবসায়ীদের দাবি, পঞ্জাবের বীজ উন্নতমানের, এতে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে চাষিদের দাবি, যতই ভাল বীজ হোক, ফলন না দেখলে তো নিশ্চিত হওয়া যায় না। ফলে ঝুঁকির আলু চাষে ঝুঁকি কমে না কখনওই।
বীজের মান পরীক্ষার জন্য নেই পর্যাপ্ত আধুনিক ব্যবস্থাপনা। ফলে ফসল ওঠার আগে বোঝা সম্ভব নয় কেমন হবে উৎপাদন। তা সে পঞ্জাবের আলুবীজের গুণগত মান যতই ভাল হোক না কেন। শুধু ফলন ভাল হলেই যে চিন্তামুক্ত হওয়া যায়, তা নয়। চন্দ্রকোনা রোড, গড়বেতার অনেক আলু চাষি-ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘কম ফলন হলে আর্থিক ক্ষতিতে পড়তে হয়। ফলন বেশি হলেও, তার সঠিক মূল্য পাওয়া ও ঠিকঠাক ভাবে বাজারজাত করার চিন্তা থাকে।’’ এই মরসুমের উদাহরণ দিয়ে আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘২০১৪ সালের মতো ২০২৪ সালেও ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠাতে দেয়নি রাজ্য সরকার। জেলা সীমানায় প্রশাসন জোরজবরদস্তি করে আলু গাড়ি আটকে দিয়ে প্রচুর হয়রানি করেছে। এতে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে চাষি থেকে ব্যবসায়ী প্রত্যেকের। এ ভাবে সরকার দমন-পীড়ন চালালে আলু চাষ ও ব্যবসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’’
আলু বীজ ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বিশ্বজিৎ সিংহরায় বলেন, ‘‘প্রতি বছর আলু নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়। আলু নিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত।’’ জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক অবশ্য বলছেন, ‘‘চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ধান, আলু, পেঁয়াজ, টোম্যাটো প্রভৃতি কিনে সরকার নিজে বিক্রি করার ব্যবস্থা করছে। চাষিদের চিন্তার কিছু নেই।’’
অভয় দিচ্ছে প্রশাসন। তবু নির্ভয় হতে পারছেন না চাষি, ব্যবসায়ীরা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)