Advertisement
১১ মে ২০২৪
Coromondel Express Accident

ছেলের দেহ আনতে সেই করমণ্ডলেই

তেমনই একজন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সন্দেশখালির রঞ্জিত মণ্ডল। দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ছিল তাঁর বছর আঠারোর ছেলে, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র দীপঙ্কর।

ছেলের খোঁজে রঞ্জিত মণ্ডল করমণ্ডলে চড়ে ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল 

ছেলের খোঁজে রঞ্জিত মণ্ডল করমণ্ডলে চড়ে ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল 

দেবমাল্য বাগচী
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩ ০৭:৫২
Share: Save:

ছেলে অজয়ের মৃত্যু হয়েছিল আমেরিকায়। নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে তাঁর অস্থিটুকু দেশে ফিরিয়ে আনতে লড়াইয়ের অন্ত ছিল না বৃদ্ধ পিতার। শোক করার সময় পাননি পুত্রহারা বি ভি প্রধান।

অনুপম খের অভিনীত সারাংশ ছবির সে সব দৃশ্য আর সংলাপ আজও দাগ কাটে। ওড়িশার বাহানাগা ট্রেন দুর্ঘটনা এমনই অনেক সন্তানহারা বাবা-মাকে জীবনের সব থেকে বড় লড়াইয়ের সামনে এনে ফেলেছে। তাঁরা জেনে গিয়েছেন চরম সত্যিটা। এখন দেহের ভিড়ে ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।

তেমনই একজন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সন্দেশখালির রঞ্জিত মণ্ডল। দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ছিল তাঁর বছর আঠারোর ছেলে, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র দীপঙ্কর। সেই থেকে আর খোঁজ নেই। ওড়িশার একাধিক মর্গে ঘুরেও হদিশ পাননি। ভুবনেশ্বরের এমসের মর্গে ১৫৬নম্বর দলা পাকানো দেহের জামা দেখে সন্দেহ হয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসেছিলেন ছবির সঙ্গে ওই দেহের পরনে থাকা জামাটা মিলিয়ে দেখতে। নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন। এ বার সেই করমণ্ডল এক্সপ্রেসেই ভুবনেশ্বর রওনা দিলেন রঞ্জিত- ছেলের দেহ আনতে।

বাহানাগা বাজারে দুর্ঘটনার পাঁচদিন পরে বুধবারই প্ররথম করমণ্ডল ছুটল চেন্নাইয়ের উদ্দেশে। যাত্রীদের বেশিরভাগের চোখে মুখেই ছিল আতঙ্ক। তাঁদেরই অন্যতম রঞ্জিত। তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে চেন্নাইয়ে প্রথমবার রাজমিস্ত্রির কাজে যাচ্ছিল দীপঙ্কর। সাধারণ অসংরক্ষিত আসনে সফর করছিল সে। দুর্ঘটনার পরে ওড়িশায় গিয়ে বাহানাগা হাইস্কুল, বালেশ্বর হাসপাতাল, সোরো হাসপাতাল, নসি বিজনেস সেন্টার-ছেলের খোঁজে কোনও মর্গ বাদ দেননি রঞ্জিত। গাড়ি ভাড়া চোকাতে নিঃস্ব হওয়ার জোগাড়। শেষে ভুবনেশ্বরের এমসের মর্গে ১৫৬ নম্বর দেহর জামাটা চেনা লাগে। কিন্তু বিকৃত মুখ দেখে চেনার উপায় ছিল না। ছবি তুলে আনেন। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর থেকে জানতে পারেন ওই জামাই পরে গিয়েছিল ছেলে।

তার পর শুরু হয় ওই জামা পরা অবস্থায় ছবির খোঁজ। দেখা যায় বাড়ির অ্যালবামে নিজের তোলা একটি ছবিতেই ছেলে পরে রয়েছে সেই চেক শার্ট। এ দিন মোবাইলবন্দি সেই ছবি নিয়েই ছেলের দেহ আনতে জামাই নিবাস মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে করমণ্ডলে ওড়িশা গেলেন রঞ্জিত। বললেন, “ভেবেছিলাম ভুল হচ্ছে। তাই ছেলের দেহ ছেড়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু জামার ছবি মিলিয়ে দেখলাম হুবহু এক। জানি দেহটা একেবারে গলে-পচে গিয়েছে। কিন্তু সেটাই তো বুকে জড়িয়ে এনে ওর মাকে দিতে পারব।”

এ দিনের করমণ্ডলে অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক। পেটের তাগিদে ভয় ভুলে রওনা দিয়েছেন তাঁরা। গত ২জুন করমণ্ডলের যে কয়েকটি কামরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল এস-১, এস-২ ও দু’টি জেনারেল কামরা। এ দিন সেই এস-২ কামরার যাত্রী নদিয়ার পলাশিপাড়া তন্ময় হাজরা বলেন, “চেন্নাই সেন্ট্রালে কাঠমিস্ত্রির কাজ করি। এই ট্রেনেই যাতায়াত করি। ছুটিতে এসেছিলাম। সে দিনের দুর্ঘটনা চোখে ভাসছে। ভয়ও কাজ করছে। কিন্তু পেটের দায়ে যেতে তো হবেই!” একই কথা বলছিলেন এস-১ কামরার যাত্রী বিহারের মুতিয়ারির বাসিন্দা চেন্নাইয়ের একটি মিলের কর্মী অজয় কুমার। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও অফিসের ডাকে চেন্নাই যেতে হচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির সৌরভ বেরাকে। তাঁর কথায়, “তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করি। ৩ জুন টিকিট ছিল। ট্রেন বাতিল হয়ে যাওয়ায় যেতে পারিনি। দুর্ঘটনার পরে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু পেট যে বড় দায়!” এ দিন ওই ট্রেনের চালক ছিলেন সুভাষচন্দ্র দাস। খড়্গপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার আগে বারবার হাত জোড় করে প্রণাম করছিলেন। পাশে বসে তাঁর ঊর্ধ্বতন চিফ লোকো ইন্সপেক্টর অনুপ মান্না বললেন, “২ জুন আমার এই করমণ্ডলেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গিয়েছিলাম শতাব্দীতে। একেই হয়তো বলে ভাগ্য।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Train accident Kharagpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE