করোনার আতঙ্কে দাঁড়ি পড়ছে না। সংক্রমিতের দেহ সৎকার ঘিরেও রয়েছে নানা প্রশ্ন। করোনায় মৃতের সৎকার সুষ্ঠুভাবে করতে নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্য। সুস্পষ্ট নির্দেশিকার অভাবে এ ক্ষেত্রে জটিলতা অব্যাহত।
পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম— দুই জেলাতেই করোনায় মৃতের অন্ত্যেষ্টি ঘিরে জট পাকছে। প্রশাসনিক বাধা না থাকলেও মৃতের পরিজনেদের অনেকে দেহ নিতে চাইছে না। বহু এলাকায় অশান্তি দেখা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারিভাবে সৎকারের ব্যবস্থা হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সদর মেদিনীপুর ও পাশের শহর খড়্গপুরে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দেহ সৎকার সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে। এখন করোনায় মৃতদের দেহ দাহ করা হয় মেদিনীপুরের শ্মশানে। মেদিনীপুরে দু'টি বৈদ্যুতিক চুল্লি রয়েছে। হঠাৎ করে চুল্লি বিকল হওয়ায় একদিন দেহ দাহে সমস্যা হয়েছিল মেদিনীপুরে। সে দিন দেহগুলি খড়্গপুরে পাঠানো হয়েছিল। মেদিনীপুরের পুর-প্রশাসক দীনেন রায় বলেন, ‘‘পরিজনেরা দেহ নিতে না চাইলে সরকারি উদ্যোগে দাহ করা হচ্ছে। কোনও সমস্যা নেই।’’
রেলশহরে করোনার মৃতদেহ সৎকারে মন্দিরতলা শ্মশানের চুল্লি ব্যবহার হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে চুল্লি বিকল থাকায় মেদিনীপুরে পাঠানো হচ্ছিল দেহ। এখন সেই সমস্যা নেই। তবে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন থাকায় সৎকারে সময় লাগছে। দিন কয়েক আগে ভবানীপুরে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধের বাড়িতে মৃত্যুর পরে সৎকারে এগিয়ে আসেনি কেউ। কোনও চিকিৎসক শংসাপত্রও দিতে চায়নি। পরে পুরপ্রশাসক গিয়ে কোয়াক ডাক্তার ডেকে শংসাপত্র জোগাড় করলে সৎকারের ব্যবস্থা হয়। পুরপ্রশাসক প্রদীপ সরকার বলেন, “করোনা মৃতদেহ সৎকারে চুল্লি ও শববাহী গাড়ি আমাদের রয়েছে। কিন্তু অনেক এলাকায় মানুষ ও চিকিৎসকেরা এগিয়ে না আসায় সমস্যা হচ্ছে। এখন সৎকারে কোয়াক ডাক্তারদের শংসাপত্রও গ্রহণীয়।” দিন কয়েক আগেও মহকুমার খড়্গপুর-১ ব্লকের বলরামপুরে বাড়িতে ৮ ঘণ্টা করোনা রোগীর মৃতদেহ বাড়িতে পড়েছিল। আবার সবংয়ে হাসপাতালে ২৭ ঘণ্টা আইসোলেশন ওয়ার্ডে পড়ে ছিল করোনায় মৃতের দেহ। দু’টি ক্ষেত্রেই জেলার একটিমাত্র শববাহী গাড়ি থাকায় সমস্যা হয়েছিল। যদিও মহকুমাশাসক আজমল হোসেন বলেন, “এখন বাড়িতে বা হাসপাতালে করোনায় মৃত্যুতে দেহ পরিজনকে দেওয়া যাবে। কেউ না নিলে সরকারি নিয়মে সৎকার হবে। প্রতিটি গ্রামীণ ব্লকেও শববাহী গাড়ি নামাচ্ছি।”
অবশ্য বাড়িতে মৃত্যুতে স্থানীয় পঞ্চায়েত কী করবে তার সুষ্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। গড়বেতার তিনটি ব্লকের অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতই ধন্দে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক পঞ্চায়েতই মৃতের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে। গড়বেতা পঞ্চায়েতের প্রধান শ্যামল বাজপেয়ী বলেন, “বাড়িতে মৃত্যুর খবর এলে আমরা সৎকারে সাহায্য করছি।’’ কয়েকদিন আগে গোয়ালতোড়ের কেশিয়ায় নিভৃতবাসে থাকা এক ব্যক্তির দেহ দাহ করতে উদ্যোগী হতে হয় স্থানীয় পঞ্চায়েতকে। গড়বেতা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ বলেন, “প্রতিটি পঞ্চায়েতকে বলেছি করোনার মৃতদেহ দাহ করা নিয়ে যাতে কোনও বিশৃঙ্খনা হয়। সে রকম হলে পঞ্চায়েত নিজ উদ্যোগেই দাহ করবে।”
ঘাটাল-সহ মহকুমার পাঁচটি পুর এলাকাতেই মৃতদেহ স্থানীয় শ্মশানে দাহের ব্যবস্থা করেছে পুরসভাগুলি। কিন্তু ঘাটাল মহকুমার পঞ্চায়েত এলাকায় কোথাও এই উদ্যোগ শুরু হয়নি। মহকুমাশাসক শৌভিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুর এলাকায় তেমন সমস্যা নেই। কিছু পঞ্চায়েতেও স্থানীয় শ্মশানে দাহ শুরু হয়েছে।
পাশের জেলা ঝাড়গ্রামে করোনায় মৃতদেহ দাহ করার জন্য গত বছর অগস্ট থেকে নহড়খাল শ্মশানটি নিদিষ্ট করা হয়েছে। ঝাড়গ্রাম পুরসভার তত্ত্বাবধানে সেখানে কাঠের চিতায় মৃতদেহ দাহ করা হয়। তালতলা শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি থাকলেও সেটি এখনও চালু করা যায়নি। জেলার আটটি ব্লকেও সৎকারের স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের জন্য অবশ্য এতদিন জামবনির টুনকাশোলে গোরস্থানটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। জেলার ৬৪টি গ্রামের সংখ্যালঘুদের নিয়ে গঠিত কমিটির সদস্য শেখ ইরশাদ আলি বলেন, “বিভিন্ন ব্লকস্তরে দেহ গোর দেওয়ার স্থান নির্দিষ্ট করার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।” জেলা পরিষদের সভাধিপতি মাধবী বিশ্বাসের কথায়, “দেহ সৎকার ও কবর দেওয়ার একাধিক জায়গা করার জন্য প্রশাসনিকস্তরে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
তথ্য সহায়তা: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, বরুণ দে, কিংশুক গুপ্ত, অভিজিৎ চক্রবর্তী ও দেবমাল্য বাগচী