Advertisement
E-Paper

মুড়াডাঙার শৈশব বাঁচাতে দত্তক নিচ্ছে মহিলা কলেজ

ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন দৌড়ে বেড়ায়। বাড়ির কেউ ফিরেও তাকায় না। একটু বড় হলেই ওরা অবশ্য সামিল হয়ে যাবে অন্য দৌড়ে। কেউ যাবে সাইকেল মেরামতির কাজে, কেউ খাবার দোকানে কাজ নেবে, কেউ বা অন্য কিছু— রোজগারের তাগিদ। এরই মধ্যে একদিন হানা দেবে নেশা।

বরুণ দে

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০১:৪৯
বুধবার কলেজ চত্বরে শিশুরা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

বুধবার কলেজ চত্বরে শিশুরা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন দৌড়ে বেড়ায়। বাড়ির কেউ ফিরেও তাকায় না। একটু বড় হলেই ওরা অবশ্য সামিল হয়ে যাবে অন্য দৌড়ে। কেউ যাবে সাইকেল মেরামতির কাজে, কেউ খাবার দোকানে কাজ নেবে, কেউ বা অন্য কিছু— রোজগারের তাগিদ। এরই মধ্যে একদিন হানা দেবে নেশা।

মেদিনীপুর শহরের অদূরে মুড়াডাঙায় এ ভাবেই হারিয়ে যায় শৈশব। অনেক দিন ধরেই এমনটা দেখছেন রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ বার তাঁরাই উদ্যোগী হলেন ছবিটা অন্তত কিছুটা বদলাতে। ওই এলাকার ৩১ জন শিশুকে ‘দত্তক’ নিলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। সকলেই তফশিলি উপজাতিভুক্ত। বয়স পাঁচ থেকে দশ। প্রাথমিক শিক্ষাটুকু যাতে ওরা পায় তার ব্যবস্থা করবেন কলেজের শিক্ষক আর ছাত্রীরা। সঙ্গে থাকবে নাচ-গান, আঁকা— জীবনের সব রং।

কলেজের অধ্যক্ষা জয়শ্রী লাহা বলেন, “কলেজের কাছেই তো ওরা থাকে। এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কলেজেরও একটা সামাজিক কর্তব্য থাকে। আমরা ৩১ জন ছেলেমেয়েকে ‘দত্তক’ নিলাম।’’ ওদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরাও খুব খুশি। এই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ সার্বিক মানোন্নয়নের যাবতীয় দায়িত্ব কলেজ গ্রহণ করছে।

ভাবনা ঠিক কী? কলেজের হস্টেলে ছাত্রীরা থাকেন। এক-একজন ছাত্রীকে ওই এক-একজন শিশুর ‘মেন্টর’ হিসেবে রাখা হচ্ছে। তাঁরাই শিশুদের দেখভাল করবেন। শিশুদের কেউ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে পড়াশোনা করে, কেউ প্রাথমিক স্কুলে। সকালে তারা স্কুলেই যাবে। বিকেল ৩টে নাগাদ কলেজে চলে আসবে। ৫টা পর্যন্ত থাকবে এখানেই। এই সময়ের মধ্যেই তাদের লেখাপড়া, নাচ-গান শেখানো হবে। মাঠে গিয়ে খেলার জন্যও একটা সময় বরাদ্দ থাকবে। সময় করে মাঝে মধ্যেই দেখানো হবে শিশু চলচ্চিত্রও। বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু এই কার্যক্রম।

কর্তৃপক্ষের ডাকে সাড়া দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বুধবার কলেজে এসেছিলেন রানি সিংহ, যমুনা সিংহ, পুতুল সিংহরা। রানিদেবীর মেয়ে স্নেহা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে পড়াশোনা করে। এই গৃহবধূর কথায়, “কলেজ মেয়েকে মানুষ করলে ভালই হবে। ও এখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে।” যমুনাদেবীর দুই মেয়ে। পাবর্তী আর নেহা। স্বামী গোপাল সিংহ দিনমজুরি করেন। সামান্য আয়। টেনেটুনে সংসার চলে। এই গৃহবধূর কথায়, “তেমন লেখাপড়া জানি না। ওদের সে ভাবে দেখভাল করতে পারি না। তবে আমি চাই, মেয়েরা পড়াশোনা শিখুক। বড় হোক।” পুতুল সিংহের মেয়ে দীপিকা প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। স্বামী জয়দেব সিংহ দিনমজুর। পুতুলদেবী বলছিলেন, “কলেজের কথা শুনে সত্যিই ভাল লেগেছে। এখানে এলে মেয়ে পড়াশোনা শিখতে পারবে। যত্নেও থাকবে।”

আবার মেন্টর হতে পেরেই দারুণ খুশি সুজাতা সিংহ, প্রিয়াঙ্কা খাটুয়া, সুদেষ্ণা মণ্ডলরা। কলেজের আবাসিক ছাত্রীরা বলছেন, “বেশ ভাল লাগছে। কলেজের এই উদ্যোগ একেবারে অন্যরকম। ওদের কিছু শেখাতে পারলে আরও ভাল লাগবে।” কলেজের শিক্ষিকা সুতনুকা পালের কথায়, “আশা করি, এই উদ্যোগ
ফলপ্রসূ হবে।”

মুড়াডাঙ্গার মতো এলাকায় শৈশব হারিয়ে যাওয়ার পিছনে মাদকও একটা বড় কারণ। শুধু মদ-গাঁজা-হেরোইন-চরস কিংবা ব্রাউন সুগার নয়, বহু অপ্রচলিত বা স্বল্পপরিচিত মাদকও ঢুকে পড়ে মেদিনীপুরের এই সব পিছিয়ে পড়া এলাকায়। শুধু যুবকেরা বা পরিবারের বড়রা নয়, স্কুলপড়ুয়ারাও আক্রান্ত। কলেজের এক শিক্ষিকা বলছিলেন, “শিশু সুরক্ষায় সচেতনতা আরও বাড়ানো জরুরি। না-হলে সামনে বড় বিপদ। মাদক সব শেষ করে দিতে পারে।”

এলাকার অনেকে যে শৈশবেই রোজগারের ঠিকানা খুঁজে নেয় তা মানছেন গ্রামবাসীরাও। এক গৃহবধূর কথায়, “কাজ না-করলে কী করে চলবে? কাজের জন্যই ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছাড়ে।” কলেজ কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ওই ৩১ জন ছেলেমেয়েকে পোশাক দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন তাঁরা। সোম থেকে শুক্র-সপ্তাহের এই পাঁচদিন তারা কলেজে আসবে। কলেজে আসারও নিয়ম তৈরি করেছেন কর্তৃপক্ষ। জুড়ে দেওয়া হয়েছে বাবা, মা-দেরও।

এক একদিন এক-একজন অভিভাবক সব ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে নিয়ে এসে কলেজে ছেড়ে দিয়ে যাবেন। আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। ক্যাম্পাসে পৌঁছনোর পরে মেন্টররাই শিশুদের দেখভাল করবেন। শিশুদের টিফিনও দেওয়া হবে। অধ্যক্ষা জয়শ্রীদেবীর কথায়, “সামর্থ্যের মধ্যে থেকে যা যা করা সম্ভব, আমরা ওদের জন্য করব।”

Muradanga children
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy