লিপি তৈরিতে ব্যস্ত জয়ন্ত মাহাতো। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
কুড়মিদের উন্নয়নের জন্য পৃথক কুড়মি উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এ রাজ্যে এখনও কুড়মি (মাহাতো) সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক কুড়মালি ভাষা প্রসারে সরকারিস্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
কুড়মিদের দীর্ঘদিনের দাবি, এ রাজ্যে স্কুল ও কলেজস্তরে কুড়মালি ভাষায় পঠনপাঠন চালু হোক। জঙ্গলমহলের ৪২ শতাংশ মানুষের ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ারও দাবি তুলেছে কুড়মি সংগঠনগুলি। কিন্তু তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে কুড়মিদের দাবি নিয়ে সেভাবে উচ্চবাচ্য হয়নি। কেবলমাত্র ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে একবার সংসদে কুড়মালি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছিল তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে কুড়মি সংগঠনগুলির দাবিগুলি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তারপর রাজ্য সরকারের তরফে আর এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এবার ফের মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলে এসে পৃথক কুড়মি উন্নয়ন পর্ষদ গড়বেন বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেই পর্ষদের কী ভূমিকা হবে, তা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন কুড়মিরা।
পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ় ও অসমে বসবাসকারী কুড়মালিভাষীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫ লক্ষ কুড়মি রয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলার পাশাপাশি, দুই চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও দুই দিনাজপুরেও কুড়মিভাষীরা রয়েছেন। জঙ্গলমহলের তিন জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় বসবাসকারী মোট জন সংখ্যার ৪২ শতাংশ মানুষ কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। জঙ্গলমহলে শুধু কুড়মিরাই নন, পাশাপাশি, বাগাল, রাজোয়াড়, দেশওয়ালি’র মতো অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও কুড়মালি ভাষায় কথা বলেন। তা সত্ত্বেও এ রাজ্যে কুড়মালি ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড রাজ্যে কুড়মালি ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে কুড়মালি ভাষায় পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ভারতীয় সংববিধানের ৩৪৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনও রাজ্য সরকার মনে করলে সেই রাজ্যের কোনও আঞ্চলিক ভাষা ও তার লিপিকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৯ সালে সাঁওতালি ভাষার অলচিকি লিপিকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তার প্রায় দু’দশক পরে সাঁওতালি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পশ্চিমবঙ্গে এখনও সরকারি ভাবে কুড়মালি ভাষায় পঠনপাঠনের কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে ‘অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসইআ সোসাইটি’ নামে একটি কুড়মালি ভাষা ভিত্তিক সংগঠনের উদ্যোগে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও মালদহ জেলার মোট ৫৪ টি অস্বীকৃত অবৈতনিক স্কুলে প্রাথমিকস্তরে কুড়মালি ভাষায় পঠনপাঠন চলছে। ওই ৫৪টি স্কুলে অবশ্য ‘কুড়মালি চিসই’ লিপিতে পড়ানো হয়। এই কুড়মালি লিপির স্রষ্টা হলেন ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক জয়ন্ত মাহাতো। ‘অল ইন্ডিয়া কুড়মালি চিসইআ সোসাইটি’র সম্পাদক জয়ন্তবাবু নিজের তৈরি করা কুড়মালি লিপি ও ব্যকরণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে জানিয়েছেন। এখনও সরকারি স্বীকৃতি মেলে নি। তবে সেই লিপিতে জয়ন্তবাবুর লেখা মুদ্রিত পাঠ্যবই পড়ছে কুড়মি শিশুরা। জয়ন্তবাবুর বক্তব্য, “শিক্ষার অধিকার আইনে বলা আছে, শিশুর শিক্ষার মাধ্যম হবে তার মাতৃভাষা। ভাষাগত সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া শিশুরা যাতে কোনও মতেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সে কথাও আইনে বলা আছে। কিন্তু কুড়মালিভাষী শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”
ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী সুধাংশুশেখর মাহাতো বলেন, “কুড়মিদের উন্নয়ন করতে হলে আগে আমাদের কুড়মালি ভাষার সরকারি স্বীকৃতি প্রয়োজন। কুড়মিদের স্বতন্দ্র সংস্কৃতি রয়েছে। অথচ জঙ্গলমহলের ঝুমুর গানের শিল্পীরা আজও এ রাজ্যে বেতার ও দূরদর্শনে ব্রাত্য।” আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতা অশোক মুতরুয়ারও মত, ‘‘কুড়মিদের পরবগুলিতে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়। ঝাড়খণ্ডের বেতার ও দূরদর্শনে কুড়মালি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ঝাড়খণ্ড রাজ্যকে দেখে কুড়মি ভাষা প্রসারে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা নেওয়া উচিত।” অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণমন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতোর অবশ্য দাবি, “কুড়মিদের দাবির বিষয়গুলি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে রয়েছে। কুড়মি উন্নয়ন পর্যদ গঠিত হলে কুড়মি সম্প্রদায়ের উন্নতি হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy