Advertisement
E-Paper

এমন কুপ্রথা থামাতে লড়তে হবে সকলকে

দৃশ্য-১। ২০১৪। ঝাড়গ্রামের কুসুমডাঙা গ্রাম। ডাইনি সন্দেহে তিন মহিলাকে মারধর। অপমানে আত্মঘাতী ১ মহিলা। ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। ডাক পড়ল আমাদের কুরকুট নাট্য সংস্থার। আমরা কয়েকজন মিলে নানা বিষয়ে সচেতনামূলক অঙ্গন নাটক পরিবেশন করি। এই নাটকে মঞ্চ, আলো, মেক-আপ এসব কিছুরই দরকার পড়ে না। ফলে, খুব সহজেই দর্শকদের সঙ্গে কথোপকথন ও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০১:০৭
উপল পাহাড়ি

উপল পাহাড়ি

দৃশ্য-১। ২০১৪। ঝাড়গ্রামের কুসুমডাঙা গ্রাম। ডাইনি সন্দেহে তিন মহিলাকে মারধর। অপমানে আত্মঘাতী ১ মহিলা। ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। ডাক পড়ল আমাদের কুরকুট নাট্য সংস্থার। আমরা কয়েকজন মিলে নানা বিষয়ে সচেতনামূলক অঙ্গন নাটক পরিবেশন করি। এই নাটকে মঞ্চ, আলো, মেক-আপ এসব কিছুরই দরকার পড়ে না। ফলে, খুব সহজেই দর্শকদের সঙ্গে কথোপকথন ও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।

নভেম্বরের সকালে কুসুমডাঙা গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলার অনেক চেষ্টা করলাম। কেউই কোনও কথা বললেন না। জিতুশোলে জানগুরুর খোঁজে গেলাম। তিনি বেপাত্তা। দলের শ্যামল, দীপক, জয়ব্রত, সমীরণ-রা তথ্য অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দিলেন। প্রতিদিন এলাকায় গিয়ে নানা পেশার নানা বয়সের মানুষজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ঘটনাটিকে বোঝার চেষ্টা শুরু হল।

জানা গেল, গ্রামের এক মহিলা দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগছিলেন। ডাক্তার দেখিয়েও জ্বর সারছিল না। সেই বিষয়টিকে হাতিয়ার করে ওই মহিলার স্বামী তাঁর পড়শি এক মহিলার সম্পত্তি হাতানোর উদ্দেশ্যেই জানগুরুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সালিশিস ভায় স্বামী পরিত্যক্তা ওই মহিলার দুই সহচরীকেও ডাইন সাব্যস্ত করা হয়েছিল। যাতে কোনও ভাবে কারও সন্দেহ না হয়। অপমানে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাটি। কিন্তু মৃতার বাড়ির লোকেরা পুলিশে খবর দেননি। মৃতার মায়ের বক্তব্য ছিল, তাঁদের গাঁয়ে থাকতে হবে। থানা পুলিশ হলে একঘরে হতে হবে। পরে আমরা স্থানীয় ঘটিডুবা স্কুলে ‘আঁধার মানুষ’ নাটকটি পরিবেশ করেছিলাম। নিরন্তর কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলাম, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একশ্রেণির মানুষ ডাইনি প্রথাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর এই কুসংস্কারের নামাবলি গায়ে চাপিয়ে ভালই ব্যবসা চালাচ্ছে জানগুরু, গুণিন, ওঝারা। ওই ঘটনার পরে এলাকার কয়েকজন আদিবাসী তরুণ-তরুণী ডাইন-বিরোধী প্রচারে সামিল হয়েছেন।

দৃশ্য-২। ২০১৫।

লালগড়ের রাসমণ্ডল গ্রাম। বৃদ্ধা কালন্দি মুর্মুকে ডাইনি সাব্যস্ত করে লাঠিপেটা করে খুন করেছিলেন তাঁরই দেওর, সম্পর্কিত এক নাতি এবং জ্ঞাতিকুটুমরা।

বিধবা কালন্দিদেবী প্রতি মাসে এক হাজার টাকা সরকারি পেনসন পেতেন। জমিজমা ছিল। বাড়িতে বিপিএল বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। চাষজমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই কালন্দিদেবীকে তাঁর পরিজনরাই খুন করেছিলেন। কালন্দিদেবীর সম্পর্কিত এক নাতবৌ বাসিমণি হাঁসদার প্রবল পেট ব্যথার উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। বাসিমণির রক্তাপ্লতাও ছিল। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছিলেন বাসিমণির শরীরে রক্ত কম। হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু হল বাসিমণির।

ব্যস! রক্তচোষা ডাইনির কথা গ্রামে চাউর করে দেওয়া হল। এরপর বাসিমণির মৃতদেহ এনে গ্রামে বসল সালিশিসভা। বৃদ্ধা কালন্দিদেবীকে বলা হল, হয় বাসিমণিকে বাঁচাও নয়তো নিজে প্রাণ দাও। এরপর বাড়ির উঠোনেই ডাইনি অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারা হল কালন্দিদেবীকে। এই ঘটনায় কালন্দিদেবীর জনা দশেক আত্মীয়-জ্ঞাতিকুটুমকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সকলেই এখন জামিনে মুক্ত।

গত বছর তথ্যানুসন্ধানের পরে রাসমণ্ডল গ্রামে নাটক করতে গিয়ে বিস্তর বাধার মুখে পড়তে হয় আমাদের। আমরা কালন্দির বাড়ির উঠোনে নাটকটি করতে চেয়েছিলাম। পরে অবশ্য গ্রামের অদূরে ফুটবল মাঠে নাটকটি পরিবেশন করা হয়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও কয়েকশো মানুষ নাটকটি দেখেছিলেন। কালন্দির চরিত্রাভিনেত্রী শ্রীপর্ণা পাহাড়ি ‘মৃত্যুর পরে’ উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁকে এভাবে পিটিয়ে মারাটা কী ঠিক হয়েছিল! দর্শকরা নিশ্চুপ ছিলেন। কয়েকজন মহিলা কেঁদে ফেলেছিলেন। তবে স্মার্টফোন হাতে কয়েকজন যুবক আমাদের বলেছিলেন, শহরের আলোয় ডাইনি দেখা যায় না, ডাইনি দেখা যায় গ্রামেই! আমরা বুঝেছি, আদিবাসী গ্রামগুলিতে নিরন্তর সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। সেই কাজটা আমরা
করে যাচ্ছি।

(লেখক ঝাড়গ্রামের নাট্যকর্মী। ডাইনি কুপ্রথা নিয়ে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে সচেতনতা মূলক অঙ্গন-নাটক পরিবেশন করেন।)

Witch myth
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy