কুকুর এড়িয়েই পথ চলা। মেদিনীপুরে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
কখনও ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছে। কখনও বা কামড়ে দিচ্ছে। লাফিয়ে বাইকে উঠে আরোহীকে কামড়ানোর চেষ্টার মতো ঘটনাও ঘটছে।
পথ কুকুরদের দাপটে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন মেদিনীপুর-খড়্গপুর দুই শহরের বাসিন্দারাই। অথচ, হেলদোল নেই পুরসভার। সমস্যা স্বীকার করেও মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “এক সময় কুকুর ধরে শহরের বাইরে ছেড়ে দেওয়া হত। এখন ওই সব এলাকাতেও বসতি গড়ে উঠছে। ফলে, তার আর উপায় নেই।’’ কিন্তু নির্বীজকরণ তো সম্ভব? এ বার পুরপ্রধানের জবাব, “শহরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কুকুরের নির্বীজকরণ করে। তাদের পুরসভা সহায়তা করে। তবে এটা আরও বড় আকারে করতে হবে। দেখছি কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’
আর খড়্গপুরের পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের স্বীকারোক্তি, “কুকুর ধরে নির্বীজকরণ করার মতো পরিকাঠামো ও লোকবল আমাদের নেই। আর শহরে তেমন কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পাচ্ছি না যারা এই কাজে পারদর্শী।’’ তবে তাঁর আশ্বাস, সম্প্রতি মধ্যমগ্রামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপের চেষ্টা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে পথ কুকুরদের দাপট বাড়ছে। নাকাল হতে হচ্ছে দুই শহরের বাসিন্দাদের। মেদিনীপুরের সৌরভ সাহুর অভিজ্ঞতা, “প্রতি রাতেই বাড়ি ফেরার সময় কুকুরের তাড়া খেতে হয়। ভয়ে থাকি এই না কামড়ে দেয়।” কলেজ ছাত্রী প্রণিতা দাসও বললেন, “টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় কুকুর এড়িয়ে চলাফেরা করা রোজকার একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ একই ছবি রেলশহরে। মাস দেড়েক আগে রাতে খড়্গপুরে ইন্দার রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দা রেলকর্মী তারক চক্রবর্তী মোটরসাইকেলে রেলস্টেশনে যাচ্ছিলেন। ট্রাফিক মোড় থেকে স্টেশনের মালগুদামে ঢোকার মুখে একটি বিরিয়ানি দোকানের কাছে গোটা দশেক কুকুরের দল হল্লা বাধিয়েছিল। মোটরসাইকেলের আলো কুকুরগুলির চোখে পড়তেই তারা তারকবাবুর দিকে তেড়ে আসে। ভয়ে বাইকে থেকে পড়ে যান তিনি। হাত-পা কেটে যায়। তারকবাবু বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পরে বাড়ি থেকে রাতে বেরোতেই ভয় করছে। পাড়ার মোড়ে-মোড়ে কুকুর। অথচ পুরসভাকে কুকুরের জন্ম নিয়ন্ত্রণে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখি না।’’
দুই শহরে পথ কুকুরদের সংখ্যা কত, তারও কোনও হিসেব নেই পুরসভার কাছে। কুকুরের কোনও সুমারি হয় না। মেদিনীপুরে এক সময় পুরসভার উদ্যোগে কুকুর ধরার গাড়ি (ডগ ক্যাচার) কেনা হয়েছিল। টিকাকরণের কাজ শুরু হয়েছিল। ক্রমে সব উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ডগ ক্যাচারও আর সচল নেই। কুকুর ধরার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা মানছেন একাংশ পুরকর্তাও। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা নেই।’’ শহরে এমন কুকুরও রয়েছে, যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কারও গায়ে ঘা, কারও লোম উঠে গায়ে লালচে দাগ পড়েছে। বেশ কিছু কুকুরের স্বাস্থ্যও ভাল নয়। এই ধরনের কুকুরের রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুর-কর্তা মানছেন, “কিছু কুকুর কৃমিতে আক্রান্ত। এদের ওষুধ খাওয়ানো দরকার। বিস্কুট বা মিষ্টিতে ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরে ভ্যাকসিনও দেওয়া যেতে পারে।’’ কিন্তু সেই সব উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
পথে বেরিয়ে কুকুরের কামড়ে জখম হওয়ার ঘটনা অহরহ হচ্ছে খড়্গপুরে। প্রতিদিন ভিড় জমছে মহকুমা হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, জলাতঙ্ক থেকে বাঁচতে এআরভি এবং এআরএস নামে দু’টি ইঞ্জেকশন রয়েছে। কুকুর কামড়ালে প্রাথমিকভাবে এআরভি নিয়ম মেনে চারদিন দিয়ে মোকাবিলা করা হয়। আর গুরুতর আক্রান্তকে এআরএস দিতে হয়। এখন প্রতি মাসে গড়ে প্রায় একশোজনকে এই টিকা দিতে হচ্ছে। খড়্গপুর হাসপাতালের সুপার কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “কুকুরের কামড়ে জখমের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি না নিয়ে টিকা দেওয়া হয়। আমাদের হাসপাতালে পর্যাপ্ত এআরভি রয়েছে। কিন্তু এআরএস দামি হওয়ায় কম আসে। তবে এখনও অসুবিধা হয়নি।” আর মেদিনীপুর মেডিক্যালে মাসে প্রায় সাড়ে চারশো জন আসেন কুকুরে কামড়ানোর টিকা নিতে। বছর দুয়েক আগেও সংখ্যাটা ছিল সাড়ে তিনশো।
কিন্তু এ সবের আগে তো দরকার কুকুরের দাপট নিয়ন্ত্রণ করা। আর ফাঁক সেখানেই। মেদিনীপুরের এক পুরকর্তার স্বীকারোক্তি, ‘‘উদ্যোগেরই অভাব। আসলে সব দিকে সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না!” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “এটা ঠিক, কুকুরের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এলাকার মানুষও সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। এ বার কিছু একটা করতেই হবে।” কিছু একটা কবে হয়, সেটাই দেখার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy