খড়ের বোঝা মাথায় মোরাম রাস্তায় বাড়ি ফিরছিলেন পিন্টু মাহাতো ও তাঁর স্ত্রী প্রণতি। ১৪ বছর আগে এই দিনে ওই পথে পা ফেলার উপায় ছিল না। ২৪ নভেম্বর, ২০১১— ঝাড়গ্রামের বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেনজির দেহ। তবে বুড়িশোলের এই দম্পতি বললেন, ‘‘ও সব রক্তঝরা দিন মনে রেখে কী হবে!’’ ওই পথেই সাইকেলে আসা বছর পঁয়ষট্টির দর্পহরি মাহাতো বলেন, ‘‘দিনটা পেরিয়ে গেল না? মনে পড়ছে না ঠিক।’’
শুধু বুড়িশোলের বাসিন্দারা নন, একদা কিষেনজির সঙ্গে মাওবাদী স্কোয়াডে যাঁরা কাজ করেছেন, এখন আত্মসমর্পণ করে জীবনের মূলস্রোতে ফিরেছেন, তাঁদেরও অধিকাংশ প্রায় দেড় দশক আগের সে অধ্যায় মনে রাখতে চান না। আত্মসমর্পণ করে পুলিশে চাকরি পেয়েছেন প্রাক্তন মাওবাদী লালগড়ের মনোজ মাহাতো ও সুশীল মাহাতো। মনোজ এক সময় পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির মুখপাত্র ছিলেন। দু’জনেই বলছেন, ‘‘আগের কথা মনে করতে চাই না। এখন জঙ্গলমহল শান্তিতে রয়েছে।’’
কিষেনজির মৃত্যুর পরে, প্রতি বছর এই সময়টায় ‘শহিদ সপ্তাহ’ পালনের ডাক দিত মাওবাদীরা। জঙ্গলমহলে পোস্টারও পড়ত। বছর দুয়েক সে সব বন্ধ। তবে কি কিষেনজির মত ও পথ ভুল ছিল বলে উপলব্ধি করেছে জঙ্গলমহল? বাঁকুড়া জেলা পুলিশে এখন হোমগার্ড, একদা কিষেনজির ছায়াসঙ্গিনী প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর দাবি, ‘‘কিষেনজির ভাবধারা ভুল ছিল, এটা ঠিক নয়। এই বাংলায় পরিবর্তন এসেছে ওঁর ভাবধারার হাত ধরেই। তবে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এখন ওঁর চিন্তা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের বিশেষ প্যাকেজের আকর্ষণে সংগঠন দুর্বল হয়েছে। কিছুটা উন্নয়ন ও পুলিশি কড়াকড়িও এর কারণ।’’ সুচিত্রা জুড়লেন, ‘‘এ রাজ্যে মাওবাদীদের সংগঠন ভেঙে গিয়েছে। তাই কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না।’’
রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের বছরেই মৃত্যু হয় কিষেনজির। শান্তি ফেরে জঙ্গলমহলে। উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। ভয় ভুলে এখন জঙ্গলমহলে চাঙ্গা পর্যটনও। পাশাপাশি, দেশ জুড়ে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার হয়েছে। ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রের মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যগুলিতে গত কয়েক মাসে ধারাবাহিক অভিযান চলেছে। সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে নিহত হয়েছেন মাওবাদী শীর্ষনেতা মাডবী হিডমা। সব মিলিয়ে মাওবাদীরা কোণঠাসা। তবে ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘আমাদের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে গ্রামে-গ্রামে যাওয়ায় যোগাযোগও নিবিড় হয়েছে।’’
বুড়িশোলের যে জঙ্গলে প্রাণ গিয়েছিল কিষেনজির, তার অদূরে মাথা তুলেছে বুড়িশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়। সহ-শিক্ষক গোপাল মান্ডি জানালেন, আগে প্রাথমিক স্কুল ছিল এক কিলোমিটার দূরে। ২০১৪ সালে এই স্কুল হয়েছে। ফুটবল মাঠের পাশে কমিউনিটি হল। ছাগল চরিয়ে বাড়ি ফেরা টুটুল মাহাতো বললেন, ‘‘যে বছর বিয়ে হয়ে গ্রামে এলাম, সে বছরই কিষেনজি মারা যান। এখন সব পাল্টে গিয়েছে। ভাল আছি।’’
(সহ-প্রতিবেদন: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)