মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ।
কখন তোমার আসবে টেলিফোন!
মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায় টেলিফোনের মধুর ধ্বনি শোনার আশায় থাকতেন। তবে সরকারি হাসপাতালে প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন কর্তাব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত ভাবেন, এই বুঝি বাজল মোবাইল। এল প্রভাবশালীর অনুরোধ, ‘‘আমার একটা পেশেন্ট আছে। ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’’
দিন কয়েক আগের ঘটনা। এক প্রভাবশালীর ফোন পেয়েছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যালের এক আধিকারিক। ওই প্রভাবশালী জানিয়েছিলেন, তাঁর এক ‘পরিচিতের’ জন্য যে ভাবেই হোক একটি সিসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই ‘পরিচিত’ একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইতিমধ্যে লক্ষাধিক টাকা বিল হয়ে গিয়েছে ওই বেসরকারি হাসপাতালে। রোগী এখন অনেকটা সুস্থ। তাঁকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রাখার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। সব শুনে হাসপাতালের ওই আধিকারিক ওই প্রভাবশালীকে শুনিয়েছিলেন, ‘‘কিন্তু এখন তো সিসিইউ-র শয্যা খালি নেই। সবক’টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে।’’ জোরাজুরি করেছিলেন ওই প্রভাবশালী। তখন হাসপাতালের আধিকারিক তাঁকে শুনিয়েছিলেন, ‘‘তা হলে তো একজনকে বের করে আপনার পরিচিতকে ঢোকাতে হয়!’’ হাসপাতালের ওই আধিকারিক বলছিলেন, ‘‘আমাদের কাছে রোজ যে এমন কত ফোন আসে, তার ইয়ত্তা নেই। ভোর থেকে কল আসা শুরু হয়। গভীর রাত পর্যন্ত কল আসতেই থাকে!’’ তাঁর কথায়, ‘‘ওই ব্যক্তিকে কত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, সিসিইউ শয্যা খালি নেই এখন। উনি বুঝতেই চাইছিলেন না। অন্য রোগীকে বের করে দিয়ে তো আর একজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না।’’ তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘কিছু সময় তুলনায় বেশি সঙ্কটজনক রোগী সিসিইউ-তে জায়গা পান না, কারণ শয্যা খালি থাকে না। অথচ, তুলনায় কম সঙ্কটজনক রোগী সিসিইউ-তে থাকেন।’’
কয়েক বছর আগের ঘটনা। প্রশাসনের এক আধিকারিক অসুস্থ হওয়ায় তড়িঘড়ি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। সিসিইউ বিভাগটি পরিচ্ছন্ন, বাতানুকূল। সেখানে ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা রয়েছে। বুকে সামান্য ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় ওই আধিকারিককে সিসিইউতে ভর্তি করাতে গিয়ে দেখা যায় ১২টি শয্যার সব ক’টিতেই রোগী রয়েছেন। কয়েকজনের অবস্থা সঙ্কটজনক। হাসপাতালে ওই সময় সিসিইউতে কোনও শয্যা খালি না থাকায় অগত্যা এক রোগীকে জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। ওই সময় তৎকালীন সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, যাঁকে সরানো হয়েছিল তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। প্রশাসনের ওই আধিকারিককে একদিন ঝাড়গ্রামের হাসপাতালে রেখে কলকাতায় পাঠানো হলে সেই রোগীকে ফের সিসিইউতে ফেরানো হয়।
ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালটি বছর দেড়েক আগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘উন্নীত’ হয়েছে। তবে বাড়েনি সিসিইউ-এর শয্যা সংখ্যা। কিছু দিন আগে সর্পদষ্ট এক রোগীকে সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু সিসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় জেনারেল ওয়ার্ডে রেখে ওই রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এমনিতেই ওঝা-ঝাড়ফুঁক করে রোগীকে অনেক দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ফলে রোগীর প্রাণ বাঁচানো যায়নি। কিছুদিন আগে মেডিক্যালের এক আধিকারিককে ফোন করে এক প্রভাবশালী তাঁর চিকিৎসাধীন পরিচিতকে বাড়তি নজর দিতে বলেন। যদিও রোগীর অবস্থা তেমন গুরুতর ছিল না। তবে প্রভাবশালীর সন্তুষ্টির জন্য একাধিক চিকিৎসক গিয়ে রোগীকে পরীক্ষা করেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার নিয়মিত গিয়ে রোগীর খোঁজখবর নেন। কয়েকমাস আগে যখন রোগীর প্রবল চাপ, ওই সময় অতিরিক্ত রোগীদের মাটিতে শয্যা পেতে চিকিৎসা করা হচ্ছিল। এমনই এক সময়ে এক প্রভাবশালীর পরিচিত মাথা ঘোরা আর বমির উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তাঁকে পৃথক কেবিনে রেখে চিকিৎসা করা হয়।
ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ব্লক (সিসিবি) গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সূত্রের খবর, আরও ৯টি শয্যা বাড়িয়ে সিসিইউতে ২১ শয্যা করা হবে। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন তথা রাজ্যের মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলছেন, ‘‘জেলার বহু মানুষজন চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাকে ফোন করেন। যাঁরা প্রকৃত অসহায় ও দরিদ্র তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যালে সিসিইউ-এর শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’’
(তথ্য সহায়তা: বরুণ দে, কিংশুক গুপ্ত)
→→(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy