Advertisement
E-Paper

পড়ুয়া খুঁজে আনেন শিক্ষিকারাই

খাতায়কলমে নাম রয়েছে ২২ জন পড়ুয়ার। যদিও বেলপাহাড়ির পাটাঘর গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে দৈনিক উপস্থিত থাকে হাতে গোনা পড়ুয়া। কার্যত পড়ুয়াদের ধরে এনে মিড-ডে মিল খাওয়াতে হয় শিক্ষিকাদের। আবার অনেক সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরেও শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের খুঁজেই পান না।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৩৩
ফাঁকা: দুই খুদে পড়ুয়াকে নিয়েই চলছে ক্লাস। নিজস্ব চিত্র

ফাঁকা: দুই খুদে পড়ুয়াকে নিয়েই চলছে ক্লাস। নিজস্ব চিত্র

খাতায়কলমে নাম রয়েছে ২২ জন পড়ুয়ার। যদিও বেলপাহাড়ির পাটাঘর গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে দৈনিক উপস্থিত থাকে হাতে গোনা পড়ুয়া। কার্যত পড়ুয়াদের ধরে এনে মিড-ডে মিল খাওয়াতে হয় শিক্ষিকাদের। আবার অনেক সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরেও শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের খুঁজেই পান না।

ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি ব্লকের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম পাটাঘর। ব্লক সদর বেলপাহাড়ি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের পড়ুয়ার মধ্যে ২১ জনই আদিম শবর জনজাতিভুক্ত। প্রশাসনিক আধিকারিকদের দাবি, বাম জমানায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে সার্বিক ভাবে স্কুল ছুটের হার ছিল ১৯ শতাংশ। রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে সরকারি স্তরে স্কুল ছুটে হার অনেকটাই কমে গিয়েছে। প্রশাসনিক মহলের দাবি, জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকায় এখন স্কুল ছুটের হার মাত্র
৮ শতাংশ।

পাটাঘর এসএসকে-র বাস্তব ছবিটা অবশ্য অন্য কথা বলছে। ২২ জন পড়ুয়ার মধ্যে গড়ে তিন-চার জন নিয়মিত স্কুলে আসে। তাও আবার তাদের ধরে আনতে হয়। দুর্গম কাঁচা জঙ্গলপাহাড়ি রাস্তা উজিয়ে গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে হাজির দুই শিক্ষিকা বাসন্তী মাহাতো ও সাবিত্রী মাহাতো। কিন্তু পড়ুয়ার দেখা নেই। বাসন্তীদেবী গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দু’জন পড়ুয়াকে ধরে আনলেন। তার পর গম্ভীর মুখে বললেন, ২২ জন ছাত্রছাত্রী। গ্রাম ঘরে দু’জন পড়ুয়াকে পেলাম। বাকিরা বাবা-মায়ের সঙ্গে রুজির টানে বনবাদাড়ে ঘুরছে। অভিভাবকরাই সন্তানের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছেন।”

এরপর প্রাক প্রাথমিকের শ্যামলী শবর আর রূপালি শবরদের বোর্ডে অক্ষর চেনানোর কাজ শুরু করলেন বাসন্তীদেবী। গ্রামের এক শবর শিশু এসে বর্ণপরিচয় বই নিয়ে খেলতে শুরু করল। বাসন্তীদেবী গ্রামবাসীদের উদ্দেশে ফের হাঁক পাড়েন, আর কী কেউ আজ ‘ইস্কুলে’ আসবে? হাঁক ডাকের অবশ্য জবাব আসে না।

মিড ডে মিল রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উষা মাহাতো, দীপালি মাহাতোরা বললেন, “বেশির ভাগ দিন রান্না করে শিশুদের ডেকে খাওয়াতে হয়। কোনও কোনও দিন আবার পড়ুয়াদের খুঁজেই পাওয়া যায় না। তবু আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছি।”

কেন এই পরিস্থিতি? অভিভাবক তারাপদ শবর বলেন, গ্রামে তো চলার পথই নেই। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরনোর পরে হাইস্কুল দশ কিলোমিটার দূরের ভুলাভেদায়। ভুলাভেদা যাওয়ার জন্য লালজলে মোড়ে বাস ধরতে গেলে পাঁচ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে বা সাইকেলে যেতে হয়। তাছাড়া এলাকায় সেচের অভাবে সারা বছর চাষাবাদ হয় না। সেই কারণে সিংহভাগ এলাকাবাসী জঙ্গলের শালপাতা, কেন্দুপাতা, ভেষজ উদ্ভিদের মতো বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে মহাজনের কাছে বিক্রি করে সংসার চালান। পরিবারের শিশুরাও বাবা মায়ের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে বন সম্পদ সংগ্রহের কৌশল শেখে। একটু বড় হলে তারাও শাল পাতা কুড়োয়, কেন্দু পাতা তোলে।

গ্রামবাসী শ্রীমতি শবর বলেন, “ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠালে মাত্র এক বেলা ওদের খিদে মেটে। স্কুলের চেয়ে জঙ্গলে গেলে সংসারের অনেক সাশ্রয় হয়।” স্থানীয়রা জানালেন, গোটা গ্রামের চারপাশে জঙ্গল আর পাহাড়। সাত কিলোমিটার হেঁটে অথবা সাইকেলে গিয়ে আসরি গ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে রেশনের চাল নিয়ে আসতে হয়। গ্রামের একমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ পেশায় চাষি মৃত্যুঞ্জয় কিস্কু বলেন, “শুধু মিড-মে মিল দিয়ে স্কুলছুট ঠেকানো সম্ভব নয়। দুর্গম এলাকায় উপযুক্ত নিশ্চয়তার অভাবে পড়ুয়ারাও স্কুলে যাচ্ছে না। তারা বুঝে গিয়েছে, জঙ্গলের বনজ সম্পদ বেচে দৈনিক দু’শো-তিনশো টাকা নগদে রোজগার হয়।”

ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ সঞ্চিতা ঘোষের দাবি, “জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলছুটের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। সন্তানের স্কুলছুট ঠেকাতে অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা নিতে হবে।”

Education Students Teacher Mid Day Meal মিড ডে মিল Self Help Group
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy