Advertisement
E-Paper

পরব থেকে ঝুমুর গান, বাঘের বাসা সংস্কৃতিতে

সুন্দরবনের দক্ষিণ রায়ের মতো জঙ্গলমহলেও রয়েছেন ব্যাঘ্রদেবতা ‘বাঘুত’। এখনও কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবে গৃহস্থের গোয়াল ঘরে বাঘুতের পুজো হয়।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৮ ০০:২০
বৃথা: ফাদ-খাঁচা পাতাই সার। দেখা নেই বাঘের। রবিবার লালগড়ের জঙ্গলে।  ছবি: দেবরাজ ঘোষ

বৃথা: ফাদ-খাঁচা পাতাই সার। দেখা নেই বাঘের। রবিবার লালগড়ের জঙ্গলে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

ফাঁদ-ক্যামেরায় বাঘের ছবি মেলার পরে লালগড়ের রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য নিয়ে নানা চর্চা চলছে। এই তল্লাটে বাঘ কোত্থেকে এল, কেনই বা এল তা খুঁজতে হয়রান বনকর্তারাও। জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতির ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। সেখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাঘের নানা কাহিনি।

সুন্দরবনের দক্ষিণ রায়ের মতো জঙ্গলমহলেও রয়েছেন ব্যাঘ্রদেবতা ‘বাঘুত’। এখনও কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবে গৃহস্থের গোয়াল ঘরে বাঘুতের পুজো হয়। মাঘ মাসের প্রথম দিনে গরাম থানে বাঘ-দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের প্রথা চলে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে বলেন, “জঙ্গলমহলের মূলবাসীদের কাছে বাঘ কোনও নতুন বিষয় নয়। এখানকার লোককথায়, লোকক্রীড়ায়, দেবদেবীর ভাবনায়, গ্রামের নামে রয়েছে বাঘের প্রসঙ্গ। প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলের মূলবাসীরা বাঘের সঙ্গে পরিচিত।”

মধুপবাবু জানালেন, ষোড়শ শতকে কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে জঙ্গলমহলের ভিতর দিয়ে চৈতন্যমহাপ্রভুর যাত্রাপথের বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘পালে পালে ব্যাঘ্র-হস্তী-শূকরগণ’-এর উল্লেখ রয়েছে। জঙ্গলমহলের জনপ্রিয় লোকক্রীড়া ‘বাঘ-ছাগল’ ও ‘বাঘবন্দি’। প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে এখন অবশ্য দু’টি খেলাই লুপ্তপ্রায়। গোপীবল্লভপুরের বাসিন্দা আশি বছরের শশধর দে, বেলপাহাড়ির বর্ষীয়ান যদুনাথ মাণ্ডি বলেন, “এক সময় ছক কেটে দানের এই দুই খেলা খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখন আর কেউ খেলে না।’’ শুধু ঝাড়গ্রাম বা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাই নয়, পড়শি জেলা পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার মূলবাসীদের গ্রামে গঞ্জেও গ্রাম দেবতা গরাম ঠাকুরের সঙ্গে পূজিত হন ‘বাঘুত ঠাকুর’। ইতি সাক্ষাৎ বাঘের দেবতা। পুজো হয় লৌকিক মতে। কুড়মি সম্প্রদায়ের পূজারী ‘লায়া’ লৌকিক মতে পুজো করেন। অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতো নিজে একজন ‘লায়া’। চূড়ামণিবাবু বলেন, “মূলত গাছতলায় গরাম থানে কিংবা শীতলা থানে মাটির হাতি-ঘোড়ার ছলনে বাঘুতের অধিষ্ঠান। সুন্দরবনের দক্ষিণ রায়ের মতো বাঘুতের কোনও প্রচলিত রূপ নেই। ব্যাঘ্র দেবতার উদ্দেশ্যে মূলত মুরগি বলি দেওয়া হয়।’’ জানা গেল, কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবে গোয়াল ঘরে বাঘুতের উদ্দেশে মুরগি বলি দেওয়া হয়। এ ছাড়া পয়লা মাঘ আইখ্যান যাত্রার দিনে গরাম থানে বাঘুতের পুজো হয়।

ঝাড়গ্রামের লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও মানছেন, জঙ্গলমহলের বাঘ সংস্কৃতি বেশ প্রাচীন। গ্রাম দেবতার সঙ্গে ব্যাঘ্রদেবতার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্য হল, গৃহস্থের গবাদি গরু ছাগলগুলি যেন জঙ্গলে চারণভূমিতে গিয়ে অক্ষত থাকে। জঙ্গলে গিয়ে বাসিন্দাদেরও যেন কোনও ক্ষতি না হয়। গবেষক মধুপ দে জানান, বাঘকে যেমন দেবতা জ্ঞানে পুজো করার প্রচলন রয়েছে। তেমনই বাঘ ও হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে গৃহপালিত প্রাণি ও মানুষকে রক্ষা করার জন্য রয়েছেন লৌকিক দেবদেবীও। উল্লেখযোগ্য, ঝাড়গ্রামের জামবনি এলাকার স্বর্গবাউড়ি, লায়েক-লায়েকান, নয়াগ্রামের কালুয়াষাঁড়। ঝুমুর সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রাণী মাহাতো জানান, জঙ্গলমহলের জনপ্রিয় ঝুমুর গানেও এলাকায় একসময় বাঘের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, ‘বন বাদাড় কাটিকুটি বাঘ-ভালুক ঢাড়াই পিটি, বসমতাই বনাউলঁ বসতি’। বনবাদাড় কেটে, বাঘ-ভালুক তাড়িয়ে বসতি গড়ার উল্লেখ রয়েছে এই গানটিতে।

লোকায়ত ধারা তাই বলছে, জঙ্গলমহলে বাঘ ‘নয়া হানাদার’ নয়।

Tiger culture Tiger ancient culture Jungle Mahals
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy