Advertisement
E-Paper

খালপাড়ের হাট থেকে রফতানি হত মিছরি

সেটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল। মেদিনীপুর ক্যানেলের পাড়ে বালিচকে তখন মস্ত হাট বসত। নৌকো বোঝাই হয়ে রফতানি হত লোয়াদার মিছরি। মিছরি শিল্পের দিন আর নেই। বালিচকের বদলে ব্যবসায়িক কেন্দ্রও এখন ডেবরা। আর সেখানে এখন জাতীয় সড়কের ধারে হোটেল-গাড়ি-মার্বেল ব্যবসার রমরমা।

দেবমাল্য বাগচি

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৩৭
এখানেই আগে নিত্যদিন বসত হাট। বর্তমানে লুপ্তপ্রায় বালিচকের হাট। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।

এখানেই আগে নিত্যদিন বসত হাট। বর্তমানে লুপ্তপ্রায় বালিচকের হাট। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।

সেটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল। মেদিনীপুর ক্যানেলের পাড়ে বালিচকে তখন মস্ত হাট বসত। নৌকো বোঝাই হয়ে রফতানি হত লোয়াদার মিছরি।

মিছরি শিল্পের দিন আর নেই। বালিচকের বদলে ব্যবসায়িক কেন্দ্রও এখন ডেবরা। আর সেখানে এখন জাতীয় সড়কের ধারে হোটেল-গাড়ি-মার্বেল ব্যবসার রমরমা।

ডেবরার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। ফলে, এখানে ব্যবসার সূচনাও হয়েছিল চাষবাসের হাত ধরে। এখন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ডেবরা হলেও পুরনো কেন্দ্র কিন্তু ছিল বালিচক। স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত বলাইচন্দ্র হাজরা রচিত ‘ডেবরা থানার ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, আনুমানিক ১৮৩৫-৩৬ সালে ডেবরা থানার বাড়াগড় গ্রামে নীলকুঠি তৈরি করে। তখন অত্যাচারের মুখে চাষাবাদ ধাক্কা খেলেও কৃষকেরা চাষবাস ছেড়ে দেননি। আর কৃষির উপর নির্ভর করেই বালিচকে ব্যবসার গোড়াপত্তন।

তখন অবশ্য বালিচকে কোনও রেলস্টেশন ছিল না। যোগাযোগের সুবিধার্থে বালিচকের উপর দিয়ে মাতকাতপুর থেকে কোলাঘাট পর্যন্ত খাল খনন করা হয়েছিল কোম্পানির আমলে। সেই মেদিনীপুর ক্যানেলের ধারেই বিশাল হাট বসত। কাঁসাই ঘেঁষা লোয়াদা বিখ্যাত ছিল মিছরি তৈরির জন্য। সেই মিছরি এই হাট হয়েই অন্যত্র পাড়ি দিত। সেই খাল এখন মজে গিয়েছে। যেখানে হাট বসত, সেই এলাকা ছেয়ে গিয়েছে ঝুপড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ নিরঞ্জন ধুলিয়া স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বছর চল্লিশেক আগেও আমি এই হাটের ধারেই খাবারের দোকান সামলাতাম। নৌকা করে জিনিসপত্র যেত-আসত। এখন ভাবলে স্বপ্ন মনে হয়।” সোম ও শুক্র এখনও হাট বসে বটে। তবে সেই জাঁক আর নেই।

সেই সময় সারা বাংলায় প্রসিদ্ধি ছিল ডেবরার চালেরও। সেই সূত্রেই এখানে গড়ে ওঠে একের পর এক চালকল। হরিমতি, শিবদুর্গা, গঙ্গা, বিজয়লক্ষ্মী, হরিহর রাইস মিলের ব্যবসার রীতিমতো রমরমা ছিল। চাষাবাদ ছেড়ে অনেকেই রাইস মিলে কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছিলেন। আশির দশকের পর থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। শ্রমিক অসন্তোষ, সর্বত্র একই ধারার ব্যবসার কারণে ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় চালকলগুলি।

এরপর ডেবরায় রমরমা বাড়ে ফুল চাষের। গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ চাষ করে বছরে ২৫-৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উপার্জনের রাস্তা খুলে যায়। ডেবরাচকের কাছেই বাড়াগড়ে ফুল চাষ করে বছরে ২৫ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন চিত্তরঞ্জন জানা। তিনি বলেন, “৩৫ বছর ধরে ফুলচাষ করছি। আগে লোকের জমিতে চাষ করতাম। পরে নিজের ১২ কাঠা দিয়ে চাষ শুরু করেছিলাম। এখন ৫ বিঘা জমি কিনেছি। আরও ১৫ বিঘা ভাড়া নিয়ে ফুলচাষ করছি।” ফুল চাষে সাহায্য দানে এগিয়ে এসেছে কৃষি উন্নয়ন সমিতিও। বাড়াগড় সমিতির সম্পাদক পৃথ্বীশ ভট্টাচার্য বলেন, “ফুলচাষের জনপ্রিয়তা বাড়াতে আমরা প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করছি। তাতে ভাল সাড়াও পাচ্ছি।” তবে এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হল বাজারের অভাব। ডেবরার ফুলচাষিদের এখনও যেতে হয় পাঁশকুড়ার কেশাপাট বাজারে। ডেবরায় তাই ফুলের বাজার খোলার দাবি উঠেছে।

এই মুহূর্তে এলাকার যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ডেবরাচক। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর এখানেই রয়েছে ডেবরার মূল বাজার। ২০০০ সালের আগে কিন্তু ডেবরায় ব্যবসার তেমন প্রসার ছিল না। সোনালি চতুর্ভূজ প্রকল্পে ছয় লেনের জাতীয় সড়ক বাণিজ্যের দরজা খুলে দেয়। গড়ে ওঠে একের পর এক হোটেল-ধাবা, পাইকারি ব্যবসা, গাড়ি ও ভারী যানবাহনের গ্যারাজ গজিয়ে উঠছে। কারণ, জাতীয় সড়ক চওড়া হওয়ায় যানবাহন চলাচল বেড়েছে। সঙ্গে আনাগোনা বাড়ছে মানুষের। আর সেই সূত্রে জমছে ব্যবসা। স্থানীয় এক ধাবার মালিক প্রবীন মনজিৎ সিংহ বলেন, “আমার বাবা একসময় গাড়ি চালাতেন। তখনই ডেবরায় চলে আসেন। সেই সময় জাতীয় সড়ক এত চওড়া ছিল না। পরে এখানে ধাবা গড়ে তোলেন বাবা। ক্রমে ধাবার চাহিদা বাড়ছে।”

নতুন নতুন ব্যবসা গড়ে উঠলেও তার সমৃদ্ধিতে অন্তরায় কিন্তু পরিকাঠামোর অভাব। বালিচক রেলগেট সংলগ্ন বাজার এলাকায় উড়ালপুলের দাবি দীর্ঘদিনের। রেল ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই উড়ালপুল হওয়ার কথা। কিন্তু এখন তা বিশ বাঁও জলে। বালিচক বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক কাজল গোস্বামী বলেন, “এক সময় এই এলাকায় ব্যবসার রমরমা ছিল চোখ ধাঁধানো। কিন্তু নানা সমস্যায় ব্যবসাপত্র এখন ধুঁকছে। ছোট ছোট গ্রামেও সব সামগ্রী পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে, গ্রামের মানুষ বালিচকমুখি হচ্ছে না। তার উপর এখানে আসতে রেলগেটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। উড়ালপুল হবে বলেও হচ্ছে না।” বালিচকের লজ মালিক শুকদেব সামন্ত জানালেন, নিকাশি ও লো-ভোল্টেজের সমস্যা ব্যবসায় বাধা তৈরি করছে।

রয়েছে অন্য সমস্যাও। ডেবরাচকে জাতীয় সড়ক সম্প্রসারিত হলেও বাজারের ভিতরে রাস্তা ক্রমেই সঙ্কীর্ণ হয়েছে। জাতীয় সড়ক থেকে বাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় জবরদখল বাড়ছে। বাজার ঘিঞ্জি হওয়ায় বাড়ছে যানজট। ডেবরা-বালিচক এবং ডেবরা-মাড়োতলা রুটের বাসগুলি জাতীয় সড়কে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। ফলে, পথ চলতে বাড়ে ভোগান্তি। স্থানীয় চিকিৎসক তপনকুমার চক্রবর্তীর কথায়, “ডেবরা চকের বাজারে এখন তো যানজটে চলাই দায়। প্রশাসনের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।”

এর সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে নিকাশি, পথবাতির সমস্যা। বহু দাবির পরে বাজারে একটি শৌচালয় তৈরির তোড়জোর শুরু হয়েছে। ডেবরা বাজার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সৌগত শী বলেন, “গত পনেরো বছরে ব্যবসা বেড়েছে। কিন্তু নিকাশি, রাস্তাঘাটের সমস্যা, জবরদখলের জেরে যানজট মোকাবিলা খুব প্রয়োজন। সর্বত্র এ সব জানিয়েছি। নিজেরাও কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছি। সমস্যা মিটে গেলে বাজার আরও ফুলেফেঁপে উঠবে।” স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মুনমুন সেনের বক্তব্য, “আসলে জমির বড় অভাব। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করতে পারছি না।”

debmalya bagchi amar shohor debra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy