Advertisement
E-Paper

টি শার্ট-ছাতাতেও পট, জোর বিপণনে

বছর ছয়েক আগে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর পটশিল্পীদের সংস্থা ‘চিত্রতরু’র উদ্যোগে যখন পিংলার নয়া এলাকায় পটের মেলা শুরু হয়েছিলো তখন স্লোগান ছিল ‘শিল্পী বাঁচলে শিল্প বাঁচবে’।

কিংশুক আইচ

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৩৮
‘পটমায়া’র স্টলে নানা পসরা। রয়েছেন শিল্পীও। নিজস্ব চিত্র।

‘পটমায়া’র স্টলে নানা পসরা। রয়েছেন শিল্পীও। নিজস্ব চিত্র।

বছর ছয়েক আগে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর পটশিল্পীদের সংস্থা ‘চিত্রতরু’র উদ্যোগে যখন পিংলার নয়া এলাকায় পটের মেলা শুরু হয়েছিলো তখন স্লোগান ছিল ‘শিল্পী বাঁচলে শিল্প বাঁচবে’। উদ্যোক্তারা বুঝেছিলেন, শিল্পকর্ম সৃষ্টি করলেই হবে না, তার বাজার তৈরি করাও জরুরি। সেই কাজে গ্রামের পটুয়াদের সাহায্য করেছিল সংস্থাটি। ফল মিলেছে তাতে। নয়া গ্রামের আনোয়ার চিত্রকরের আঁকা পট এখন ২৫-৩০ হাজার টাকায় বিকোয়।

শিল্প আর শিল্পীর উত্তরণ রীতিমতো স্পষ্ট ষষ্ঠ বর্ষের পটের মেলা ‘পটমায়া’র প্রাঙ্গণে। গত শুক্রবার মেলা শুরু হয়েছে। প্রায় ৭০টি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের বাড়িতে শুধু সাবেক পট আঁকছেন না, তাঁদের হাতে শিল্প ফুটে উঠছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট, ছাতা আর ঘর সাজানোর নানান জিনিসে। ঘুরে ঘুরে সে সব পসরা দেখছেন, কিনছেন কলকাতা-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তের মানুষ। সেই ভিড়ে বিদেশিরাও আছেন। সনাতনী ভাবনার গণ্ডি ছাড়িয়ে বহতা নদীর মতোই পটশিল্প যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে তা গুণগ্রাহীদের আচরণেই মালুম পড়ছে। কেনাকাটা, দরাদরি, কোলাহল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রীতিমতো জমে উঠেছে পটের মেলা পটমায়া।

রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্রশিল্প এবং বস্ত্র দফতর আর ইউনেসকো-র উদ্যোগে এই নয়া গ্রামেই তৈরি হবে গ্রামীণ হস্তশিল্প কেন্দ্র (rural craft hub)। তার দায়িত্ব পেয়েছে মেলার উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটিই। রাজ্যের ‘খাদি বিকাশ ইন্ডাস্ট্রি বোর্ড’ এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করবে। পুঁজি হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। গ্রামের মাঝে পটশিল্পীদের পুরোনো কমিউনিটি ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তৈরি হবে দোতলা ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’। পটুয়াদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকবে সেখানে। সংস্থার পক্ষে নির্মাল্য রায় জানালেন, গ্রামের শিল্পীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বেশ কিছু শিল্প বিপণির। এতে বাজারের পরিধি বাড়বে বলেই তাঁদেরর আশা।

মেলা জুড়ে পটের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা শিল্পীদের কথায় বেঁচে ওঠার কাহিনি। শম্ভু চিত্রকর, সানোয়ার চিত্রকর বা স্বর্ণ চিত্রকররা জানালেন, ১৫-২০ বছর আগে পটিদার মানে পটশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পটের গান শুনিয়ে বেড়াতেন। গান শুনে কেউ দিতেন টাকা, কেউ আবার চাল-ডাল। আর এখন গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে। মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করে এমন পরিবারের সংখ্যা কম নয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ সন্তানদের এই গ্রামের শিল্পীরা পটুয়াই বানাতে চান। সেই লক্ষ্যে প্রতি রবিবার নিয়ম করে পট আঁকার ক্লাস বসে। তাতে যেমন গ্রামের কচিকাঁচারা যোগ দেয়, তেমনই আশেপাশের গ্রামের লোকও আসে।

গ্রামের বাসিন্দা দশম শ্রেণির পড়ুয়া মনোরমা চিত্রকর ভবিষ্যতে পটুয়া ছাড়া আর কিছু হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। তাই পড়াশোনা আর আঁকা একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সেই গতানুগতিক পটচিত্র মানে মনসা মঙ্গল, রামায়ণ বা সাঁওতালদের বিয়ে তো ধীরে ধীরে একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে। ভাবনার বিষয় বদল কি জরুরি নয়। তা যে জরুরি, বিলক্ষণ জানেন আনোয়ার চিত্রকর, সোনালি চিত্রকররা। আনোয়ার জানালেন, গতানুগতিক পট আঁকার পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু করেছেন। যা শিল্পীকে আলাদা করে পরিচিতি দেবে। আর আনোয়ারের আঁকা পটেও তারই প্রতিফলন। স্যারোগেট মাদার বা রামের বনবাস আর পাঁচটা গতানুগতিক পটচিত্রের মতো না। বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট) ভাবনার প্রভাব পড়েছে তাঁর আঁকায়। সোনালি চিত্রকরও জানালেন একই কথা। তাঁর আঁকা দুর্গা বা বাবু-বিবির পট বিকোয় ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকা দামে। বিদেশের মিউজিয়াম ভাল পটের জন্য ৫০ হাজার টাকাও দাম দেয়। আর পট আঁকা শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার-কামিজ বা ছাতা বিকোচ্ছে দেদার। রয়েছে নানা ঘর সাজানোর জিনিসও।

দুর্গাপুজোর সময়ে এখানে এসে পট আঁকা শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন বিমলকুমার রায় ঘটক। মেলায় এসেছেন দাদা কমল রায় ঘটককে নিয়ে। রজতকান্তি সুর, দেবদত্ত চৌধুরী, মৌসুমী সেনরা মেলা দেখে অবাক। জানালেন দারুণ পরিবেশে মেলা হচ্ছে। একই রকম অভিভূত কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের প্রিন্সিপাল কর্মাশিয়াল অফিসার জোনাথন টি ওয়ার্ডের। মনোরম প্রকৃতি আর শিল্পের সমাহার দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘জাস্ট আমেজিং। ছুটির দিনতা দারুণ কাটল।’’

কচিকাঁচা থেকে প্রবীণ গ্রামের সকলেই পট আঁকার পাশাপাশি বিকিকিনিতে ব্যস্ত। মেলার ক’দিন গোটা গ্রামকে একটা আস্ত ক্যানভাস বললেও ভুল কিছু বলা হয় না। সারা দেশ যখন ধর্মীয় আর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে আকচাআকচিতে ব্যস্ত, সেখানে সম্প্রীতির ছবি ধরা পড়ে এই পটের গ্রামে।

গ্রামের পটুয়ারা সবাই মুসলমান। তাঁরা নমাজ পড়েন, রোজা রাখেন। পালন করেন নানা ধর্মীয় আচার। তাঁরাই আবার রামায়ণের, মনসা মঙ্গলের, দুর্গার পট আঁকেন, গান শোনান। ক্যানভাসের রং আর শিল্প ভাবনা ছাপিয়ে যায় সব কিছুকে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy