Advertisement
E-Paper

ভোট আসতেই হানাহানির বলি দুই

উত্তর থেকে দক্ষিণে ভোট গড়িয়ে আসতেই শুরু হয়ে গেল অশান্তি। শুক্রবার রাতেই বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে গুরুতর জখম হয়েছিলেন তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা। শনিবার দুপুরে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হতেই সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৫৬
. ঘাটাল হাসপাতালে সিপিএম কর্মী প্রহ্লাদ রায়।

. ঘাটাল হাসপাতালে সিপিএম কর্মী প্রহ্লাদ রায়।

উত্তর থেকে দক্ষিণে ভোট গড়িয়ে আসতেই শুরু হয়ে গেল অশান্তি।

শুক্রবার রাতেই বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে গুরুতর জখম হয়েছিলেন তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা। শনিবার দুপুরে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হতেই সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর-তাণ্ডব চলে। ঘাটালে সূর্যকান্ত মিশ্রের সভা থেকে ফেরার পথে রাতে পিটিয়ে মারা হয় সিপিএমের এক তরুণ কর্মীকে।

এ দিন সকালেই পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণচকে আক্রান্ত হন সিপিএমের জেলা নেতা বিজয় পাল-সহ এক দল নেতা-কর্মী। বর্ধমানের মঙ্গলকোটে মহম্মদ সেলিমের সভা থেকে ফেরার পথে মারে জখম হন সিপিএমের সাত জন। দুপুরে দুর্গাপুরে বিজেপি কর্মীদের ওপরেও হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ভাতারেও এক বিজেপি কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

হাটগোবিন্দপুরে নিহত তৃণমূল কর্মীর নাম অমিতাভ পাঁজা (৪৫)। বর্ধমান ২ ব্লক তৃণমূল যুবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঘাটালে নিহত সিপিএম কর্মীর নাম প্রহ্লাদ রায় (২৩)। বাড়ি চন্দ্রকোনার পুড়শুড়িতে।

সূর্যকান্তবাবুর বক্তব্য, “শাসকদল ভয় পেয়েছে। মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ভোট দিচ্ছেন, এটা বুঝতে পেরে তারা এখন হামলার পথে গিয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, হামলা বেড়ে গেল রাজ্যে দু’টো পর্বের ভোট হয়ে যাওয়ার পরে। নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন, দ্রুত তারা কড়া ব্যবস্থা নিক। কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষকে বলছি, লুডোর জেতা পালিটাকে ওল্টাতে দেবেন না।”

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে যে ক্রমাগত কুৎসা ও অপপ্রচার চলছে, তারই পরিণতিতে এই ঘটনা। হেরে যাবে বুঝতে পেরে সিপিএম এখন গোলমাল পাকাচ্ছে। দলের কর্মীদের বলছি, কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না। এমন কিছু করবেন না যাতে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে ওঠে এবং বিরোধীরা অপপ্রচারের সুযোগ পেয়ে যায়।” জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথও একই কথা বলেছেন।

সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের অভিযোগ, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বর্ধমান এই দুই জেলাতেই নির্বাচন কমিশন আগের পুলিশ সুপারকে বদলি করা সত্ত্বেও প্রশাসনের একাংশের মদতে জেলায় থেকে কার্যত তাঁরাই পুলিশ চালাচ্ছেন। কমিশনের কাছে এই নিয়ে অভিযোগ জানানো হচ্ছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্ত অবশ্য বলেন, “খবর পেয়েই অতিরিক্ত জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপার বড় বাহিনী নিয়ে হাটগোবিন্দপুরে যান। বিকেলে কিছু লোকজন ওখানে জড়ো হয়েছিল। পুলিশ তাদের বাধা দিলে কিছুটা গোলমাল হয়। দু’এক জন তাতে জখম হয়েছে। রাত পর্যন্ত পুলিশ রয়েছে।”

কর্মী-সমর্থকদের উপর হামলার প্রতিবাদে ঘাটাল-পাঁশকুড়া রাজ্য সড়কে সিপিএমের অবরোধ।

সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের অভিযোগ, “সকালেই গ্রামে গিয়ে পুলিশ তাণ্ডব চালিয়েছিল। বিকেলে তাদের সামনেই তৃণমূল হামলা চালায়। প্রশাসনকে বারবার বলেও লাভ হয়নি। আমরা নির্বাচন কমিশনকে সব জানাচ্ছি।” বর্ধমানের পুলিশ সুপার মিরাজ খালিদ অবশ্য দাবি করেন, “পুলিশ ওই সময়ে গ্রামের অন্য দিকে ছিল। দু’টি পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে।” স্থানীয় সূত্রের খবর, গণ্ডগোল অন্যত্রও ছড়িয়েছে। সন্ধে থেকেই গোটা এলাকায় বাস বন্ধ। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পেয়ে রাতেই পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে আমি হাটগোবিন্দপুরে গিয়েছিলাম। দু’টি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে, আরও দু’তিনটি বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে দেখেছি। রাত থেকেই ওই এলাকায় সিআরপি রুটমার্চ শুরু করেছে।” পুলিশ জানায়, রাত পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সিপিএম সূত্রের খবর, তৃণমূলের সন্ত্রাসে গত তিন বছর ধরে হাটগোবিন্দপুরে তাদের সব পার্টি অফিস বন্ধ ছিল। ১ এপ্রিল প্রার্থী সাইদুল হককে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করা হয়। একটি পার্টি অফিসও ফের খোলা হয়। অমলবাবুর অভিযোগ, “শুক্রবার গভীর রাতে তৃণমূলের লোকেরা দলবদ্ধ ভাবে ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। স্থানীয় সিপিএম নেতা প্রদীপ বিশ্বাসের বাড়িতে ঢুকে লুঠপাট চালায়। মোটরবাইক ও আসবাব ভাঙচুর করে। প্রদীপবাবুকে মারধর ও তাঁর স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করা হয়। আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন অমিতাভ পাঁজা। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ তৃণমূলের আক্রমণ প্রতিরোধ করলে তিনি আহত হন।”

দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাটগোবিন্দপুরের পঞ্চাননতলা এলাকায় বেশ কিছু তির ছড়িয়ে রয়েছে। দু’তিনটি জায়গায় দেখা গিয়েছে চাপ-চাপ রক্ত। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নিহত নেতার আত্মীয় তরুণ ধারা অভিযোগ করেন, “অমিতাভ পুকুরে মাছ চাষ করত। প্রায়ই মাছ চুরি হচ্ছিল বলে রাতে পুকুর পাহারা দিতে যেত। গত রাতে সিপিএমের আড়াইশো-তিনশো সমর্থক তাঁকে ঘিরে ধরে। মাছ ধরার জাল দিয়ে জড়িয়ে দিয়ে টাঙ্গির কোপ মারা হয়। তিরও ছোড়া হয়। তৃণমূলের লোকজন ছুটে আসায় সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।” জেলার পুলিশ সুপার মিরাজ খালিদ অবশ্য দাবি করেন, “পতাকা-ফেস্টুন ছেঁড়াকে কেন্দ্র করেই গোলমাল।”

গুরুতর আহত তৃণমূল কর্মীকে এ দিন সকালে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতাল সুপার দীপাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মাথায় গভীর ক্ষত ছাড়াও সারা শরীরে আঘাত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁকে দেখতে যান মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। দুপুর দেড়টা নাগাদ অমিতাভবাবুর মৃত্যু হয়।

ঘাটাল শহরে সূর্যবাবুর সভা ছিল বিকেলে। সন্ধ্যার পরে একটি পিক আপ ভ্যানে জনা দশেক সিপিএম কর্মী-সমর্থক ফিরছিলেন। সিপিএমের অভিযোগ, বড়দা চৌকান এলাকায় ভ্যানটিকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছোড়ে তৃণমূলের লোকজন। মাথায় চোট পেয়ে প্রহ্লাদ রায় নামে এক কর্মী গাড়ি থেকে পড়ে গেলে তাঁকে ইট-লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারা হয়। বাকিরা পালিয়ে বাঁচেন। পরে পুলিশ এসে প্রহ্লাদকে ঘাটাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কিছু ক্ষণের মধ্যেই তিনি মারা যান। ঘটনার পরে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়ক অবরোধ করে সিপিএম। জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “পুলিশ যদি অভিযুক্তদের না ধরে, আমরা ঘাটাল অচল করে দেব।” জেলা পুলিশ সুপার শিসরাম ঝাঝরিয়া বলেন, “অভিযোগ পেয়েই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে।”

পশ্চিম মেদিনীপুরেরই নারায়ণচকে মিছিলের প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে সকালে আক্রান্ত হয়েছিলেন সিপিএমের জেলা নেতা বিজয় পাল-সহ বেশ কয়েক জন নেতা-কর্মী। বিজয়বাবু এবং সিপিএমের লোকাল সম্পাদক আফসারুল হোসেনকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরে সূর্যবাবু তাঁদের দেখতে গিয়ে বলেন, “তৃণমূল ভয় পেয়েছে। আসলে নেত্রী বুঝে গিয়েছেন, লোকসভা ভোটটা পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো করতে পারবেন না।” জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষ অবশ্য দাবি করেন, “ঘটনার সঙ্গে আমাদের কেউ জড়িত নয়।” রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতারও হয়নি। শুক্রবার মালদহের মানিকচকে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে তৃণমূলের নির্বাচনী এজেন্ট ইশা খানের (৩২) মৃত্যুতে অবশ্য এ দিন চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাতে ওই জেলারই বৈষ্ণবনগরে আবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুই তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমাবাজি ও বাড়িতে ভাঙচুর-লুঠপাটের অভিযোগ উঠেছে।

—নিজস্ব চিত্র।

loksabha election ghatal violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy