ইশারা করতেই মঞ্চ থেকে তরতরিয়ে নেমে এলেন।
পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যকে সাক্ষী রেখে বললেন, “৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাব।”
আরে! তা হলে তো আপনি তো সর্বোচ্চ ভোটে জেতার রেকর্ড করবেন!
নাহ! তাতেও নড়চড় হল না মুখের পেশীর।
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী মহম্মদ আলম। আদত বাড়ি কামারহাটিতে। হতে পারে, এ হেন আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দিয়েছে মোদী-মন্ত্র। অথচ ওই লোকসভার অধীনে সাতটি বিধানসভা এলাকা ঘুরে এমন বহু মানুষ পাওয়া গেল, যাঁরা মনে করতে পারলেন না বিজেপি প্রার্থীর নামটাই। সাত মাস আগে রাজনীতিতে পদার্পণ। জানা গেল, আলম প্রচারে দেদার খরচ করছেন। তাঁর আগেপিছে সাফারি-স্যুট পরা জনা বারো ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। মঞ্চ থেকে নামতেই পেশী-টেশি বার করে তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন দু’পাশে। দুধ-সাদা বিশাল গাড়ি। সবই গ্রামের মানুষদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সেই হাঁ-মুখের অভিব্যক্তি দেখেই সম্ভবত ক্যালকুলেটরে হিসেব কষছেন আলম।
ঘাটাল কেন্দ্র জুড়েই চলছে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার এই খেলা। পাঁশকুড়ার হাউরের কাছে ছয়রশিয়া গ্রামের বউ ভারতী দাসের হৃদযন্ত্র প্রায় থেমে যায় আর কী! গাছের তলায় অপেক্ষা করছেন! তাঁর ক্লাস সিক্সের ছেলেটা পর্যন্ত ‘রংবাজ’ দেখেছে! ষোড়শী মেয়ে তো ঘেমেনেয়ে অস্থির! দেব আসছে! শহুরে কিশোরীর কায়দায় সে হাত-পাখার মতো করে হাত নেড়ে বলল, “উফ্! আর অপেক্ষা করতে পারছি না। কখন আসবে!”
এই কিশোরী ভোটার নয়। শহর থেকে বহু যোজন দূরে থাকা, পুকুরে স্নান করা আর হেঁটে স্কুলে যাওয়া এই ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীরা ভিড় করছে দেবের সভায়।
ছ’ফুটের মতো হাইট। ওই রকম বেতের মতো পেটানো চেহারা। মুখে গাছ-পাকা আমের মতোই মিষ্টি হাসি। দেবকে সামনে পেয়ে ১৩ থেকে ৫৩-র মহিলারা একেবারে বিহ্বল। ঠিক যেমনটি ভেবেই এত দিন প্রচারের অন্তরালে থাকা ঘাটাল কেন্দ্রকে ভিআইপি ‘দেব’-এর হাতে তুলে দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রটির গায়েই তাই কেমন ভিআইপি-ভিআইপি গন্ধ।
পাঁশকুড়ার কেশাপাটে দেবের সভায় হাতে ডায়েরি নিয়ে সই-প্রত্যাশী যে কলেজ পড়ুয়ার সঙ্গে দেখা, সেই মনীষা সিংহ ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছেন। ভোটটা দেবকে দিচ্ছেন তো? লজ্জায় মুখ আনত করে বললেন, “সেটা এখনও ঠিক করিনি।”
সন্তোষ রাণা বললেন, “কী করে ঠিক করবে? এই কেন্দ্রের ৯০ শতাংশ ভোটারই রাজনীতিমনস্ক।” ঘাটালের এই আসনটা বহু দিন ধরে জিতে আসছে সিপিআই। ২০০৯ সালে গুরুদাস দাশগুপ্ত জিতেছিলেন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ভোটে। এখন ভোটার ১৬ লক্ষ। গুরুদাসবাবুর জায়গায় এ বার সিপিআইয়ের সন্তোষ রাণা।
কিন্তু এই যাঁরা ভিড় করছেন দেবের সভায়, প্রধানত প্রমীলা বাহিনী, তাঁরা কি সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবেন? কাঠের মিল-এর কর্মী বিমল রাণা হেসে ফেলেন, “আমার বাড়ির বৌ-মাদের ভোট কিন্তু দেবই পাবে!”
মানতে নারাজ সন্তোষবাবু। ঠা ঠা গরমে ঘুরে ছোট ছোট সভা করছেন। জানেন, গুরুদাসবাবুর মতো নামডাক নেই তাঁর। সবং-এর বারজীবনপুরের গুরুপদ জানা তো মুখের উপরে সটান বলে দিলেন, “সন্তোষবাবুর নাম তো শুনিইনি কখনও। কই আমাদের দিকে প্রচার করতেও তো দেখিনি।” পিংলা-র কাশীনাথ সাঁতরা খানিক ব্যঙ্গের সুরে বলেন, “আমরা সবাই পাল্টে গিয়েছি। এখন লাল-পার্টির নেতাদের কথা বলা যাবে না।” ফলে কোণঠাসা বামফ্রন্ট। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেই তাদের ছাতা ছেড়ে জোড়া-ফুলের আশ্রয়ে ভিড়েছেন অনেকে। তার উপরে এখনও সন্তোষবাবুরা তোতাপাখির মতো আউড়ে যাচ্ছেন, সমাজতন্ত্র-তেলঙ্গানা-তেভাগা আন্দোলনের কথা। রাস্তার পাশে দু’দশ জন শুনছেন সে কথা। দাসপুরের নিমাই রায়ের মাথার ভিতরে ঘুরে বেড়ায় দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের চিন্তা। তেভাগার কথা শুনে চুপ করে থাকেন।
ঘাটাল ও দাসপুর কার্যত তৃণমূলের ঘাঁটি। দিন কয়েক আগেই সেখানে দুই সিপিএম কর্মী নিহত হয়েছেন। পাঁশকুড়ায় সহাবস্থান রয়েছে তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেসের। বিজেপিরও কিছু ভোট রয়েছে। ডেবরা-পিংলায় মারামারি-কাটাকাটি চলছে সিপিএম-তৃণমূলে। সবং আবার কংগ্রেসের শক্ত মাটি বলে পরিচিত।
এর বাইরে রয়েছে আর একটি কেন্দ্র। সারা দেশ যাকে এক ডাকে চেনে কেশপুর। ভিসুভিয়াসের মতো যার পেটের মধ্যে সব সময়েই আগুনের স্রোত। কখনও কখনও আচমকা জেগে ওঠে। আবার শান্ত হয়ে থাকে কয়েক দিন। নির্বাচনের আগের রাতে চেনামুখগুলোই দরজায় কড়া নেড়ে বলে যায়, “কাল বাড়ি থেকে বেরিওনি। গলা কাটা যাবে।” কখনও লাল পতাকার একাধিপত্য, কখনও বিরোধীদের। এক লপ্তে এক দলের পক্ষেই ভোট যায় এখান থেকে। ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে তিনিই চার কদম এগিয়ে থাকবেন, যিনি কুড়িয়ে আনতে পারবেন কেশপুরের ওই এক লপ্তের ভোট। গত কয়েক বারের ফলাফল অন্তত তাই বলে দিচ্ছে।
কেশপুরের মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল খোলা রয়েছে জামশেদ আলি ভবনের গেট। এক সময়ে বলা হতো, আলিমুদ্দিনের সমান্তরাল সরকার চালায় এই জামশেদ আলি ভবন। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে কেশপুর থেকে মুছতে বসেছে লাল নিশান। গত পঞ্চায়েতে বেশ কিছু আসনে এই এলাকায় প্রার্থী দিতে পারেনি সিপিএম। লোকসভা ভোটের আগে সেই জামশেদ আলি ভবনের দফতর খুলে বসেছেন কৃষক সভার নেতা তরুণ রায়। জানেন, কেশপুরের মানুষকে সংগঠিত করতে না পারলে মাথায় চাঁটি মেরে বেরিয়ে যাবেন দেব। সে যতই জোড়া ফুলের একাংশ রূপোলি পর্দার এই নায়কের উপস্থিতি মেনে নিতে না পারুক। তাই দাঁতে দাঁত চিপে, ঝুঁকি নিয়ে ফের ঝাঁপ খুলেছেন তরুণবাবু। ফল যাই হোক, সিঁদুরে মেঘ দেখছে কেশপুরের আম-জনতা। ধামসাইয়ের রঞ্জিত হাজরা শুকনো ধানের আঁটির উপরে বসে বললেন, “দিন কয়েক হল আবার দেখছি লাল পতাকার মিছিল। আবার শুরু হবে সেই ঢিল ফিকাফিকি।”
ঢিল! রক্ত-ঝরা কেশপুরের এই বাসিন্দাকে বেশ বিনয়ী বলতে হবে!
কেশপুরে দফতর খুলেছেন মানস ভুঁইয়াও। বেশ কয়েক বার ঘুরেও গিয়েছেন। নিন্দুকেরা বলেন, প্রথমে নাকি লড়তেই চাননি। জানতেন, দেব দাঁড় করিয়ে দশ গোল দেবেন। শোনা যায়, রাহুল গাঁধীর জেদের সামনে হার স্বীকার করতে হয় এই কংগ্রেস নেতাকে। সবং-এর ভোট তাঁর বল-ভরসার জায়গা। কিন্তু নিজের উদ্যোগে ডেবরা থেকে সবং পর্যন্ত মখমলি রাস্তা তৈরির প্রভাব তো বড়জোর ডেবরা-পিংলা পর্যন্ত। তারপর? আরও ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে! সে সব জায়গায় কংগ্রেসের সংগঠনের অবস্থা যে কী, সে কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাঁর। তাই দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। ঘাটাল-দাসপুর-পাঁশকুড়ার সঙ্গে কেশপুরের দিকে নজর ঘোরাচ্ছেন। যতই ঘোরাচ্ছেন, ততই সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ আনছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বলছেন, “দিদিমুনি এসে বলেছে আমাকে নাকি পুঁতে দেবে! ওঁর মাথা ঠান্ডা করতে আমি সবং থেকে জবাকুসুম তেল কিনে কালীঘাটে পাঠিয়ে দেব।”
হাততালি আসছে ঠিকই। কিন্তু ভোট? সিপিএম-এর তাবড় নেতারা বলছেন, “জিততে না পারুন বেগ দেবেন মানস।”
যাঁকে বেগ দেওয়া নিয়ে জল্পনা, অনেকেরই বক্তব্য, তিনি অবশ্য প্রথম দিনের চেয়ে অনেক পরিণত এখন। মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে দুম করে আর কিছু বলে ফেলছেন না। পাশের কেন্দ্রে সন্ধ্যা রায়ের ‘বাবা তারকনাথ’ খ্যাত সেই গান, ‘নিজেই ঠাকুর বোবা যে’-র মতো মৌনী নিয়েছেন। সম্ভবত বুঝেছেন, এ বড় কঠিন ঠাঁই। মুখেচোখে স্পষ্ট ক্লান্তি। প্রচণ্ড গরমে কালো কাঁচে ঢাকা বাতানুকূল এসইউভি-র আসনে রাখা আইসবক্সও দূর করতে পারছে না সেটা। চারপাশ থেকে রাজনীতির তীব্র হলকা এসে লাগছে চোখে-মুখে। কখনও দলেরই একাংশের বিরোধিতা, কখনও সংবাদমাধ্যমের। নিজে বললেন, “জেতার অঙ্ক নিয়ে ভাবছি না। চেষ্টা করছি যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছতে।”
গ্রামের প্রমীলা বাহিনীর প্রিয় ‘রংবাজ’ তাঁর লক্ষ্যে স্থির!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy