রাস্তার দু’পাশে তোরণ। যানজট মেদিনীপুরের কলেজ রোডে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
শীতের মরসুমে এখন চারিদিকে উত্সবের ছড়াছড়ি। আর তারই প্রচারে যেখানে-সেখানে গজিয়ে উঠছে তোরণ। অনুষ্ঠান শেষেও খোলা হচ্ছে না তোরণ, ব্যানার। যত্রতত্র তোরণ তৈরি হওয়ায় এক দিকে যেমন যানজট সমস্যা বাড়ছে, অন্য দিকে নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্য। তোরণের ক্ষেত্রে পুরসভার নির্দিষ্ট নীতি নেই। এটাই সমস্যার বাড়বাড়ন্তের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
পুর-কর্তৃপক্ষ উদাসীনতার কথা মানতে নারাজ। মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “পুরসভায় জমা পড়া আবেদন খতিয়ে দেখেই তোরণ তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।” যত্রতত্র তোরণ গজিয়ে ওঠায় সমস্যার কথা মেনে শহরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস বলেন, “এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে পদক্ষেপ করা হয়েছে।” কেমন? উপ-পুরপ্রধান জানাচ্ছেন, শহরের সব ডেকরেটর সংস্থাকে নোটিস করা হয়েছিল। ডেকরেটরই তো তোরণ তৈরি করে। পরে পুরসভায় ওই সব সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকও হয়। বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শহরের যেখানে-সেখানে তোরণ তৈরি করা যাবে না। আগে তো অনুমতি নেওয়ার কোনও ব্যাপারই ছিল না। এখন তোরণ তৈরি করতে গেলে পুরসভার অনুমতি নিতে হয়।” তাঁর কথায়, “ডেকরেটর সংস্থা লিখিত ভাবেই জানায়, কতদিন ওই তোরণ থাকবে। নির্দিষ্ট সময়ের পরও তোরণ খোলা না হলে পুরসভার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই করা হবে।” কোন এলাকায় তোরণ তৈরি করা যাবে, কোন এলাকায় যাবে না, পুরসভা কী এটা ঠিক করে দিতে পারে না? জিতেন্দ্রনাথবাবুর জবাব, “অবশ্যই পারে। বিষয়টা দেখছি। এ বার কিছু একটা চেষ্টা করতেই হবে।”
বিরোধীরা অবশ্য এ ক্ষেত্রে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভাকে বিঁধতে ছাড়ছে না। শহরের কংগ্রেস কাউন্সিলর কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জনবহুল এলাকায় তোরণ তৈরি না করাই ভাল। না হলে যানজট সমস্যারও সৃষ্টি হবে। তোরণ থাকায় শহরের কয়েকটি এলাকায় এখন তা হচ্ছেও। কোথায় তোরণ তৈরি করা যাবে, কোথায় যাবে না, তা পুরসভাকেই ঠিক করে দিতে হবে। এ জন্য পুর-কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগী হতে হবে। আলোচনা করতে হবে।” সিপিএমের শহর জোনাল কমিটির সম্পাদক সারদা চক্রবর্তী বলেন, “একদিকে বলা হচ্ছে, হকারদের জন্য যানজট হচ্ছে, অন্যদিকে যেখানে-সেখানে তোরণ তৈরির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তোরণ তৈরির ক্ষেত্রে একটা নিয়ম থাকা উচিত। নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খল ভাবে হোর্ডিং- তোরণ হলে পরিবেশ এবং সৌন্দর্য দুই- ই বজায় থাকে।” বিজেপির শহর সভাপতি অরূপ দাস বলেন, “সব ক্ষেত্রেই পুরসভার পরিকল্পনার অভাব। পরিকল্পনাহীন ভাবে হোর্ডিং- তোরণ লাগানোর ফলে শহরের সৌন্দর্যই নষ্ট হচ্ছে।” শহরের গোলকুঁয়াচক থেকে পঞ্চুরচক, এই একশো-দেড়শো মিটার রাস্তার উপর এখন তিন- তিনটি তোরণ রয়েছে। কখনও কখনও চার-পাঁচটিও তোরণ থাকে! এই রাস্তার একদিকেই রয়েছে মেদিনীপুর কলেজ, মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল (বালক)।
কলেজিয়েট স্কুলের সহ- শিক্ষক দীপঙ্কর ষন্নিগ্রাহী বলেন, “আমাদের স্কুলটি হেরিটেজ স্বীকৃত। স্কুলের সামনে যত্রতত্র ব্যানার- ফেস্টুন- হোর্ডিং লাগানো অনুচিত। কিন্তু কোথায় কী! কে বোঝে উচিত- অনুচিত! কে শোনে কার কথা!” তাঁর কথায়, “এই এলাকায় তিন-তিনটি তোরণ থাকায় একদিকে তো মাঝেমধ্যে যানজট হয়ই, বিশেষ করে স্কুল- কলেজ শুরুর এবং শেষের সময়, অন্যদিকে দৃশ্যদূষণও হয়। একটা হোর্ডিংয়ে দেখলাম অনুষ্ঠানের নামের থেকে এক বিজ্ঞাপন সংস্থার নামই বড় করে লেখা থাকে! দৃশ্যদূষণ সব সময়ই খারাপ। এ ভাবে বাণিজ্যিক কারণে স্কুলের আশপাশের পরিবেশ দূষিত করা হচ্ছে।” দীপঙ্করবাবু বলেন, “প্রতিটি শহরের একটা নিজস্ব চরিত্র রয়েছে। সেখানে অপরিকল্পিত ভাবে তোরণ তৈরি করা শহরের রুচি এবং সৌন্দর্য দুইয়েরই পরিপন্থী।” এই সহ-শিক্ষকের অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন না উপপুরপ্রধানও। তাঁর কথায়, “একটা তোরণে অনুষ্ঠানের নামের থেকে এক কাপড় দোকানের নাম বড় করে লেখা রয়েছে বলে দেখেছি। পুরসভা তো কোনও সংস্থাকে বিজ্ঞাপন করার জন্য তোরণ তৈরির অনুমতি দেয়নি। যে সংস্থা ওই তোরণ তৈরি করেছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। জানিয়ে দিয়েছি, এ সব বরদাস্ত করা হবে না। আগামী দিনেও এমন কোনও অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।”
মেদিনীপুর শহরে যানজট সমস্যা নতুন নয়। শহরে আলাদা ভাবে কোনও ফুটপাথ নেই। বাধ্য হয়ে পথচারীদের রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয়। যত দিন যাচ্ছে, ততই সংকীর্ণ হচ্ছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো। দু’পাশে মাথা তুলছে একের পর এক ছোট ছোট দোকান। পরিস্থিতি দেখে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোয় ফুটপাথ অর্থাত্ পাথওয়ে তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এখনও কাজের কাজ কিছু হয়নি। শহরের মধ্যেই রয়েছে কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যাণ্ড। পশ্চিম মেদিনীপুরের উপর দিয়ে প্রায় ৮০০টি বাস চলাচল করে। প্রায় সবই বাসই শহর ছুঁয়ে যায়। অন্যদিকে, শহরে আবার যত্রতত্র বাস- অটো দাঁড়িয়ে পড়ে। যাত্রী তোলা হয়। ফলে, যানজটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। রাস্তায় ছোট- বড় গাড়ির সংখ্যাও আগের থেকে বেড়েছে। এখন শহরে মোটর বাইকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। জেলার সদর শহর। স্বাভাবিক ভাবেই এই শহর সব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জেলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ রোজ কাজ হাতে নিয়ে শহরে আসেন। শহরের রাস্তার দু’দিক কী ভাবে দখল হয়েছে? কোথাও লরি- ম্যাটাডোর- ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড রয়েছে। কোথাও গাড়ির গ্যারেজ রয়েছে। কোথাও আবার পোষাকের দোকান, ফলের দোকান, চায়ের দোকান রয়েছে। বেআইনি পার্কিংও চলে। এর উপর যেখানে- সেখানে তোরণ গজিয়ে ওঠায় সমস্যা বাড়ছে। বিভিন্ন বড় মোড়ে মোড়ে হোর্ডিংয়ের দাপট তো আছেই, যত্রতত্র রাস্তার দু’দিকে বাঁশ পুঁতে তোরণ তৈরি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চলতে থাকলে আগামী দিনে ছোট- বড় দুর্ঘটনার প্রবণতা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন অনেকে। বিশেষ করে যে ভাবে রাস্তা জবরদখল হচ্ছে তাতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy